পরকীয়া করার পর ওই নারীকে বিয়ে করেছে; তার প্রতি নসিহত

জিজ্ঞাসা–১৫৮৮: আসসালামু আলাইকুম। ভাই, আমি একজন গুনাহগার, যার হয়ত গুনাহর শেষ নাই। আমি একজন ব্যভিচারী, অন্যের হক নষ্টকারী। আমি একটি সম্পর্কে জড়িয়ে যাই। যেটা ছিল হারাম ও নিকৃষ্ট কাজ। পরনারীতে আকৃষ্ট হয়েছি। এসব কাজ যখন হত তখন মন খুব খারাপ লাগত। পরবর্তীতে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, এমন কাজ করব না। দুই জনই বিরত থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু দীর্ঘ দিন পর পাপ আবার হয়ে যায়। আাবার তওবা করি, নিজেকে ধিক্কার দেই। সেও অনুতপ্ত হয়। কথা বলা কমে যায়। এক সময় সিদ্ধান্ত নেই, যদি না সে আগের সংসার থেকে পৃথক হয় এভাবে চলাটা পাপের, আমি আর কথা বলব না, আল্লাহর হুকুম ভাঙ্গতে পরব না। পরবর্তীতে কাজীর মাধ্যমে সে ডিভোর্স দেয়। আমি, আমার বন্ধু ও তার বান্ধবী উপস্থিত থেকে ডিভোর্স দেয় তার স্বামীকে এবং আমাদের বিয়ে হবে এটাও নিশ্চিত ছিলাম না। আমার সাথে পরিচয়ের আগ থেকেই তার স্বামীর সাথে থাকবে না এমন মনস্থির করে। দোয়া করতে থাকি, আল্লাহ আমার জন্য যদি মঙ্গল হয় তাহলে ওর সাথে বৈধভাবে সংসার করার ব্যবস্থা করে দাও। না হয় পৃথক করে দাও এবং তাকে বলি, আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে। ডিভোর্সের ৮/৯ মাস পরে পারিবারিকভাবে আমাদের বিবাহ হয়। বিবাহের আগের দিনও তওবা করেছি। সালাতুল তসবিহ পড়েছি, সেও পড়েছে। আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই সাক্ষীসহ। আমার পরিবারের কিছু লোক সে তালাকপ্রাপ্তা জানে। বিষয়টা পরবর্তীতে আমার বড় বোনকেও বলি আল্লাহর ভয়ে। আমাদের ৫ মাস হল সংসার। আমরা এক সাথে নামাজ পড়ি, এক সাথে কোরআান তিলাওয়াত করি, রোযার তারাবি পড়েছি। সে পর্দা করে। যদিও পুরাপুরি হয় না। চেষ্টা করে। সে জব করে সেটার জন্য পুরাপুরি হয় না। আমার আয়-ইনকাম এত ভাল না। পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে পরলে সে জব ছেড়ে দিবে বলেছে। আমি তওবার কথা বললে পড়ে। কিন্তু আমি সারাদিন আমাদের বিয়ে আদৌ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে কিনা; এই টেনশনে থাকি। আর ওর সাথে কথা বলাই বন্ধ হয়ে গেছে। যখনই কথা বলি, বলি, তওবা পড়ো। এ নিয়ে সে বিরক্ত হয়। সারাদিন এক কথা বলি। আমি কি করব বুঝতেছি না। শুুধু কান্না করি আল্লাহর দরবারে। আর দুরুদ শরীফ পড়ি রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি অয়াসাল্লাম এর উপর। আমার ভিতরে বলে বিয়ে হয়ে নাই। আল্লাহ কি মাফ করবেন? রাসুল এর সুন্নত কি পালন হয়েছে বিয়ে করে? এখন আমার ওয়াইফ ২ মাস ১০ দিন প্রেগন্যান্ট। রোজার ২৮ তারিখে এ সুসংবাদ পাই। আমি বুঝতেছি না কি করব? আমি টেলিভিশনে খবর হতে কিছু শুনি না। শুধু মনে হয় হারাম এটা। কারো সাথে কথা বলতে গেলে মনে হয়, হারাম হয়ে গেল কিনা? ভাই, সত্যি আল্লাহকে ভয় পাই। আল্লাহ কি আমার গুনা মাফ করবেন? এমনকি স্বামী স্ত্রী এক সাথে থাকার সময় যখন মনে হয় আল্লাহ যদি কবুল না করেন; এ কথা মনে হলে দূরে সরে যাই। আমরা একজন একজনকে সালাম দেই। আমিই প্রথমে দেই। যাতে করে আমাদের উপর রহমত বর্ষিত হয়। আমি দোয়া করছি সবসময়। আমাদেরকে যেন আল্লাহ কবুল করেন।–ইচ্ছাকৃতভাবে নাম উল্লেখ করা হয় নি। 

জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله

এক. ইসলামী শরিয়ত মতে, তালাক দেয়ার ক্ষমতা স্বামীর হাতে ন্যস্ত। স্ত্রী কখনও তালাক দিতে পারে না। কেননা, রাসুলুল্লাহ বলেছেন,

مَنِ اشْتَرَطَ شَرْطًا لَيْسَ فِي كِتَابِ اللَّهِ فَلَيْسَ لَهُ، وَإِنْ شَرَطَ مِائَةَ مَرَّةٍ، شَرْطُ اللَّهِ أَحَقُّ وَأَوْثَقُ

যে এমন কোন শর্ত আরোপ করবে, যা আল্লাহর কিতাবে নেই, তা তার জন্য প্রযোজ্য হবে না; যদিও সে শতবার শর্তারোপ করে। কেননা আল্লাহর দেওয়া শর্তই সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য। (বুখারী ২৩৯১)

তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেয়, তাহলে স্ত্রী ওই ক্ষমতাবলে নিজের ওপর তালাক গ্রহণ করতে পারে। এটাকে ‘তালাকে তাফবীয’ বলে। এটা স্ত্রীর নিজস্ব ক্ষমতা নয়; বরং এটা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেয়া। (রদ্দুল মুহতার ৪/৪৫২)

দুই. প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, সুতরাং উক্ত মেয়ের আগের কাবিননামার ১৮ নং ধারাটি দেখে নিন। উক্ত ধারায় স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদানের কথা রয়েছে। উক্ত ধারায় যদি তার আগের স্বামী ‘হ্যাঁ’ লিখে কাবিননামায় দস্তখত করে থাকেন তাহলে দেখতে হবে, পরবর্তীতে মেয়েটির ডিভোর্স লেটারে কী লেখা হয়েছে। যদি এভাবে লেখা হয়, ‘আমি আমার স্বামী অমুককে তালাক দিলাম’ বা ‘প্রদান করলাম’ তাহলেও জটিলতা থেকে যায়। কেননা শরিয়তের দৃষ্টিতে তালাক প্রদানের ক্ষমতা কেবল স্বামীর, স্ত্রীর নয়।

আর যদি ডিভোর্স লেটারে এভাবে লেখা হয়, ‘আমি কাবিননামার ১৮ নং ধারায় স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আমার নিজের ওপর তালাক গ্রহণ করলাম।’ বা ‘আমি তালাক গ্রহণ করলাম’ তাহলে প্রশ্নপত্রের বক্তব্য অনুযায়ী স্ত্রীর উপর তালাক পতিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে ডিভোর্সের ৮/৯ মাস পরে আপনারা যে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছেন উক্ত বিয়ে শুদ্ধ হয়েছে। আর যদি উক্ত মেয়েকে তার স্বামী তালাক প্রদানের ক্ষমতা না দিয়ে থাকে তাহলে আপনাদের বিয়ে শুদ্ধ হয় নি। কেননা, সে এখনও তার আগের স্বামীর স্ত্রী। আর অন্যের স্ত্রীকে বিবাহ করার সুযোগ নেই।(মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ৯/৫৮২ আল বাহরুর রায়েক ৩/৩৪৩ বাদায়েউস সানায়ে ৩/১৮৭)

তিন. উপরোক্ত বক্তব্যবের আলোকে যদি আপনাদের বিবাহ শুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ, বেঁচে গেলেন। এক্ষেত্রে তখন অতীত ব্যভিচারের জন্য তাওবা করে নেয়াই যথেষ্ট হবে। কেননা, আল্লাহ তাআলা ব্যভিচারীর পরকালীন শাস্তির ওয়াদার কথা উল্লেখের পর বলেন,

إِلَّا مَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُوْلَئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًارَّحِيمًا
তবে যে তাওবা করে ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে। পরিণামে আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(সূরা আল ফুরকান ৭০)
আর আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তাওবা এবং তাওবা করেছেন; এটা বুঝানোর জন্য অধিকহারে ইস্তেফার করুন। ভবিষ্যতে আর এজাতীয় পাপকর্মে লিপ্ত হবেন না বলে দৃঢ় সংকল্প করুন। এই কাজে পুনরায় জড়িয়ে পড়া থেকে পরিপূর্ণ সতর্ক থাকুন। নেক কাজের প্রতি মনোযোগী হোন এবং তাওবা করার সময় আল্লাহ তাআলার রহমতের আশা রাখুন।
চার. কিন্তু যদি উপরোক্ত বক্তব্যবের আলোকে আপনাদের বিবাহ শুদ্ধ না হয়ে থাকে তাহলেও আপনাদের অপরিহার্য করণীয় হল তাওবা করা। আর তখন তাওবা করতে হবে এভাবে যে,

. উক্ত মেয়ের সঙ্গে এক মুহূর্তের জন্যও এক সঙ্গে বসবাস করা যাবে না। কেননা, এখনও সে আপনার স্ত্রীই হয় নি। আর আল্লাহ বলেছেন,

وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاء سَبِيلاً

তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সূরা বনী ইসরাইল ৩২)

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَأَنْ يُطْعَنَ فِي رَأْسِ أَحَدِكُمْ بِمِخْيَطٍ مِنْ حَدِيدٍ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَمَسَّ امْرَأَةً لَا تَحِلُّ لَهُ

নিশ্চয় তোমাদের কারো মাথায় লোহার পেরেক ঠুকে দেয়া ওই মহিলাকে স্পর্শ করা থেকে অনেক ভাল, যে তার জন্য হালাল নয়। (তাবারানী, ছহীহুল জামে’ ৪৯২১)

. যদি তার সঙ্গে সংসার করতে চান তাহলে আগে তার চূড়ান্ত তালাকের বিষয়টি নিশ্চিত করুন। তারপর ইদ্দত পালনের পর (তিন হায়েয পরিমাণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর) তাকে বিয়ে করে নিন। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ

আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন হায়েয পর্যন্ত। (সূরা বাকারা-২২৮)

. সার্বিক বিষয়ে উভয়ে আল্লাহর কাছে লজ্জিত হোন। অধিকহারে ইস্তেফার করুন। ভবিষ্যতে আর এজাতীয় পাপকর্মে লিপ্ত হবেন না বলে দৃঢ় সংকল্প করুন। এই কাজে পুনরায় জড়িয়ে পড়া থেকে পরিপূর্ণ সতর্ক থাকুন। নেক কাজের প্রতি মনোযোগী হোন এবং তাওবা করার সময় আল্লাহ তাআলার রহমতের আশা রাখুন।

পরিশেষে আমরা দোয়া করি, আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে গুনাহমুক্ত জীবন দান করুন। স্বচ্ছ হৃদয়ে তওবা করার তাওফিক দান করুন। দুনিয়ার সুখের উপর আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনকে প্রাধান্য দেবার মত ঈমানি শক্তি দান করুন।

والله أعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন