মা-বাবার খরচ চালানো দায়িত্ব ছেলে না মেয়ের এবং স্বামীর অবাধ্য হয়ে মায়ের দেখাশোনা করা যাবে কি?

জিজ্ঞাসা–৫৫০: আসসালামু ওয়ালাইকুম। হাদিসে আছে, মা বাবা প্রতি সন্তানের আনেক দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব যত্নের সহিত পালন করতে হবে অন্যথায় গোনাহগার হবে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে– ১। সন্তান বলতে ছেলে মেয়ে উভয়কে বুঝান হয়েছে? এক্ষেত্রে মেয়ের দায়িত্ব কতটুকু? ২। যদি কোনো মা বাবাকে তার ছেলে সন্তান দেখাশোনা না করে বা ছেলে সন্তান নাই সেক্ষেত্র্রে হাদিসে একী আছে? ৩। মেয়ে যদি বিবাহিতা হয় এবং স্বামী বা শশুরবাড়ির লোকজন মায়ের খেদমত করা পছন্দ করে না সেক্ষেত্রে কী করণীয়? ৪। মায়ের দেখাশোনার জন্য যদি কোনো লোক না থাকে, মেয়ে তার সাথে মাকে এনে রাখে এবং তাতে শশুরবাড়ির লোকজন অখুশি হয় তখন কী করণীয়? ৫। যদি স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভাল না হয় সেক্ষেত্রে মেয়ের করণীয় কী? তখন স্বামীর অবাধ্য হয়ে মায়ের দেখাশোনা করা যাবে কি? উল্লেখ্য,, মা বাবাকে দেখাশোনা করার কেউ না থাকলে হাদিস অনুযায়ী মেয়ের দায়িত্ব কতখানি এবং দেখাশোনার কেউ থাকলে দায়িত্ব কতখানি। বিস্তারিতভাবে জানালে উপকৃত হব।–উম্মে সওদা।

জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

এক- ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক নিজের মা-বাবার জন্য সামর্থ্য অনুপাতে খরচ করা, তাঁদের খেদমত করা একপ্রকার ‘সদাচারণ’- যার নির্দেশ আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে এবং রাসুলুল্লাহ তাঁর বহু হাদিসে দিয়েছেন। কেননা, উক্ত নির্দেশ সন্তানের প্রতি। আর ‘সন্তান’ বলতে ‘ছেলে-মেয়ে’ উভয়কেই বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদব্যবহার কর। (সূরা ইসরা ২৩)
হাদিস শরিফে এসেছে, আয়েশা রাযি. বলেন, রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,
إِنَّ أَطْيَبَ مَا أَكَلَ الرَّجُلُ مِنْ كَسْبِهِ ، وَوَلَدُهُ مِنْ كَسْبِهِ
নিশ্চয় মানুষের জন্য সবচে’ উত্তম রিজিক হল, নিজের উপার্জন। আর নিজ সন্তান নিজেরই উপার্জন। (আবু দাউদ ৩৫২৮)
এজন্য ইবন মুনযির রহ. বলেন,
أجمع أهل العلم على أن نفقة الوالدين الفقيرين اللذين لا كسب لهما ولا مال واجبة في مال الولد
ওলামায়ে কেরাম এব্যাপারে একমত যে, সন্তান যদি সামর্থ্যবান হয় এবং মা-বাবা যদি গরিব হয় তাহলে তাঁদের জন্য খরচ করা সন্তানের ওপর ওয়াজিব। (আল মুগনি ১১/৩৭৫)
দুই-  যেহেতু উক্ত ওয়াজিব স্বতন্ত্রভাবে সকল সন্তানের ওপর সেহেতু যেমনিভাবে যদি কোনো ‘ছেলে’ সামর্থ্য থাকার পরেও মা-বাবার জন্য খরচ না করে তাহলে সে গুনাহগার হয়। অনুরূপভাবে যদি কোনো ‘মেয়ে’ সামর্থ্য থাকার পরেও মা-বাবার জন্য খরচ  না করে তাহলে সেও গুনাহগার হয়। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيمًا.وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ
তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে `উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা। আর তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও। (সূরা ইসরা ২৩-২৪)
অন্যত্র তিনি বলেন,
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ
তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কী তারা ব্যয় করবে? বলে দাও-যে বস্তুই তোমরা ব্যয় কর, তা হবে পিতা-মাতার জন্যে,আত্নীয়-আপন জনের জন্যে…। (সূরা বাকারা ২১৫)

সুতরাং যদি মায়ের একাধিক সন্তান থাকে তাহলে মায়ের ভরণপোষণ শুধু কোনো বিশেষ সন্তান নেবে তা নয় বরং সবাইকে নিতে হবে। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাদের মায়ের ভরণপোষণ যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে নিশ্চিত করবে। অবশ্য যদি এ দায়িত্ব তাদের একজন স্বতফূর্তভাবে আদায় করে তাহলে সে অনেক সাওয়াবের অধিকারী হবে এবং অন্যান্যরা গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে।

তিন-  স্ত্রীর মায়ের জন্য সামর্থ্য অনুপাতে খরচ করা স্ত্রীর উপর ওয়াজিব; স্বামীর উপর নয়। কেননা, শাশুড়ীর খরচ চালানো স্বামীর উপর আবশ্যক নয়। বরং নিজের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের স্বাভাবিক খরচ চালানো  স্বামীর উপর আবশ্যক। তবে, স্বামীর উচিত স্ত্রীর পরিবারকে সম্মান করা। তারা দরিদ্র হলে তাদেরকে সাহায্য করা; এমনকি সেটা নিজের যাকাত ও সদকা থেকে হলেও। এ বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে যদি শাশুড়ীর খরচ চালানোর মত কেউ না থাকে।

সুতরাং স্ত্রী যদি জানে যে, স্বামীর উপার্জন থেকে স্ত্রীর মায়ের জন্য খরচ করলে কিংবা তাকে স্ত্রীর শশুরবাড়িতে রাখলে স্বামীর মন খারাপ হবে তাহলে তার জন্য খরচ করা কিংবা তাকে স্ত্রীর শশুরবাড়িতে রাখা জায়েয হবে না। কেননা, রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,

وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ زَوْجِهَا وَهْىَ مَسْئُولَةٌ

একজন স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের রক্ষক, সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। (বুখারি ৪৮০৯)

সুতরাং স্ত্রীর প্রতি আমাদের পরামর্শ হল–

১- স্ত্রীর মোহর থেকে অথবা স্ত্রীর মালিকানাধীন অন্য সম্পদ থেকে মায়ের জন্য খরচ করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে স্ত্রী একজন খাদেমা রাখতে পারেন। এব্যাপারে স্বামী স্ত্রীকে কোন বাঁধা দিতে পারবে না। দিলেও স্ত্রী তখন তার কথা মানতে বাধ্য নয়। কেননা, রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ

অসৎকাজে আনুগত্য নয় ; আনুগত্য কেবলমাত্র সৎকাজের ক্ষেত্রেই হতে হবে। (বুখারী ৭১৪৫  মুসলিম ১৮৪০)

২- স্ত্রী স্বামীকে মহব্বতের সঙ্গে শাশুড়ির খেদমত করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এমনকি তার সদকা থেকে হলেও।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five − four =