যেভাবে দোয়া করলে আল্লাহ কবুল করেন

জিজ্ঞাসা–১৩১২: দোয়া কিভাবে কবুল হয়? অর্থাৎ অনেকে বলে, দুরুদ শরিফ না পড়লে দোয়া কবুল হয় না, আবার সূরা ফাতিহার শেষ দুই আয়াত ও সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়ে দোয়া করলে কবুল হয়। তো সেটা কিভাবে/কবে /কাদের জন্য কবুল হয়?–নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।

জবাব:

এক. প্রিয় প্রশ্নকারী দীনি ভাই, দোয়া কবুল হওয়ার নিম্নোক্ত রুকন ও শর্তগুলোর প্রতি যত্নবান হলে ওই দোয়া অবশ্যই কবুল হবে, ইনশাআল্লাহ। উল্লেখ্য, রুকন ওই সকল বিষয়কে বলা হয়, যেগুলো ছাড়া দোয়াই হয় না। এগুলো অনেকটা তেমন; যেমন দেহের জন্য প্রাণ। আর শর্ত মানে যেগুলোর ওপর দোয়া কবুল হওয়া নির্ভরশীল। শর্ত পাওয়া না গেলেও দোয়া কবুল হয় না।

দোয়া কবুল হওয়ার রুকনসমুহ

১. ইখলাস তথা আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও মনোযোগের সঙ্গে দোয়া করা। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ

আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন তুমি বল, আমি তো কাছেই আছি। যখন কোন প্রার্থনাকারী আমাকে ডাকে, তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিই। (সূরা বাকারা ১৮৬)

২. দ্বিধা ও দোদুল্যমনা না হয়ে কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস অন্তরে রেখে দোয়া করা। কেননা, আবু হুরায়রা রাযি.-এর হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ বলেছেন,

ادْعُوا اللهَ وأنتمْ مُوقِنُونَ بالإجابةِ ، واعلمُوا أنَّ اللهَ لا يَستجيبُ دُعاءً من قلْبٍ غافِلٍ لَاهٍ

তোমরা দোয়া কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস (একীন) নিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া কর। তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহ্‌ কোন উদাসীন অন্তরের দোয়া কবুল করেন না। (তিরমযি ৩৪৭৯)

৩. আল্লাহর প্রতি দোয়া কবুল করার সুধারণা রাখা। কেননা, রাসুলুল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন,

أنا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بي

আমার বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা করে আমি তেমন। (বুখারী ৭৪০৫)

দোয়া কবুল হওয়ার শর্তসমুহ

১. দোয়ার ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করা। যেমন, এভাবে বলা যে, হে আল্লাহ! আগামী এক দিনের মধ্যে আমার কাজটা করে দিন। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ বলেছেন,

يُسْتَجابُ لأحَدِكُمْ ما لَمْ يَعْجَلْ، يقولُ: دَعَوْتُ فَلَمْ يُسْتَجَبْ لِي

তোমাদের কারো দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাড়াহুড়া করে বলে যে: ‘আমি দোয়া করেছি; কিন্তু, আমার দোয়া কবুল হয়নি। (বুখারী ৬৩৪০)

২. দোয়ার মধ্যে গুনাহর কিছু কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় না থাকা; যেমনটি রাসুলুল্লাহ বলেছেন,

لا يَزَالُ يُسْتَجَابُ للعبدِ ما لم يَدْعُ بإِثْمٍ أو قَطِيعَةِ رَحِمٍ، ما لم يَستعجِلْ. قِيلَ: يا رَسولَ اللهِ، ما الاستِعجالُ؟ قال: يقولُ: قَدْ دَعَوْتُ وقدْ دَعَوْتُ، فلَمْ أَرَ يَسْتَجِيبُ لي، فَيَسْتَحْسِرُ عندَ ذلك، ويَدَعُ الدُّعاءَ

বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা কোন পাপ নিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া করে। বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করে। জিজ্ঞেস করা হল: ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাড়াহুড়া বলতে কী বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন: বলে যে, আমি দোয়া করেছি, আমি দোয়া করেছি; কিন্তু আমার দোয়া কবুল হতে দেখিনি। তখন সে ব্যক্তি উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং দোয়া ছেড়ে দেয়। (মুসলিম ২৭৩৬)

৩. খাদ্য পবিত্র (হালাল) হওয়া। হাদিসে এসেছে,

ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أشْعَثَ أغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إلى السَّماءِ، يا رَبِّ، يا رَبِّ، ومَطْعَمُهُ حَرامٌ، ومَشْرَبُهُ حَرامٌ، ومَلْبَسُهُ حَرامٌ، وغُذِيَ بالحَرامِ، فأنَّى يُسْتَجابُ لذلكَ؟

রাসুলুল্লাহ এমন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, যিনি দীর্ঘ সফর করেছেন, মাথার চুল উস্কুখুস্ক হয়ে আছে; তিনি আসমানের দিকে হাত তুলে বলেন: ইয়া রব্ব, ইয়া রব্ব! কিন্তু, তার খাবার-খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পরিধেয় হারাম, সে হারাম খেয়ে পরিপুষ্ট হয়েছে তাহলে এমন ব্যক্তির দোয়া কিভাবে কবুল হবে?! (মুসলিম ১০১৫)

৪. দোয়ার ক্ষেত্রে কোন সীমালঙ্ঘন না করা। যেমন, কোনো অপরিবর্তিত বিষয়কে পরিবর্তন করে দেয়ার জন্য কিংবা কোনো অসম্ভব বিষয় কামনা করা যা হবার নয়; এগুলোও সীমালঙ্ঘনের শামিল। যেমন, কোনো পুরুষ এভাবে দোয়া করা যে, আল্লাহ! আমাকে নারী বানিয়ে দিন কিংবা এভাবে দোয়া করা যে, হে আল্লাহ! আমাকে নবী কিংবা সাহাবী বানিয়ে দিন ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

ادْعُواْ رَبَّكُمْ تَضَرُّعاً وَخُفْيَةً إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ

তোমরা তোমাদের রবকে ডাক অনুনয় বিনয় করে ও চুপিসারে। নিশ্চয় তিনি পছন্দ করেন না সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে। (সূরা আরাফ ৫৫)

দুই. দুরুদ শরিফ না পড়লে দোয়া কবুল হয় না–বিষয়টা এমন নয়; বরং দোয়ার শুরুতে ও শেষে আল্লাহর তাআলার হামদ ও রাসুলুল্লাহ এর ওপর দুরুদ থাকলে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বহু গুণে বেড়ে যায়। ইমাম নববী রহ. এ মর্মে বলেন,

أجمع العلماء على استحباب ابتداء الدعاء بالحمد لله تعالى والثناء عليه ، ثم الصلاة على رسول الله ، وكذلك تختم الدعاء بهما

আলেমগণ এব্যাপারে একমত যে, দোয়ার শুরুতে আল্লাহর তাআলার হামদ-প্রশংসা ও রাসুলুল্লাহ এর ওপর দুরুদ পড়া মুসতাহাব। অনুরূপভাবে দোয়ার শেষেও। (আলআযকার ১৭৬)

তিন. সূরা ফাতিহার শেষ দুই আয়াত নয়; বরং সম্পূর্ণ সূরা ফাতিহা এবং সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়ে দোয়া করলে কবুল হয় মর্মে সহিহ মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. বর্ণিত একটি হাদিস রয়েছে। হাদিসটি নিম্নে পেশ করা হল,

بيْنَما جِبْرِيلُ قَاعِدٌ عِنْدَ النبيِّ  ، سَمِعَ نَقِيضًا مِن فَوْقِهِ، فَرَفَعَ رَأْسَهُ، فَقالَ: هذا بَابٌ مِنَ السَّمَاءِ فُتِحَ اليومَ لَمْ يُفْتَحْ قَطُّ إلَّا اليَومَ، فَنَزَلَ منه مَلَكٌ، فَقالَ: هذا مَلَكٌ نَزَلَ إلى الأرْضِ لَمْ يَنْزِلْ قَطُّ إلَّا اليَومَ، فَسَلَّمَ، وَقالَ: أَبْشِرْ بنُورَيْنِ أُوتِيتَهُما لَمْ يُؤْتَهُما نَبِيٌّ قَبْلَكَ: فَاتِحَةُ الكِتَابِ، وَخَوَاتِيمُ سُورَةِ البَقَرَةِ، لَنْ تَقْرَأَ بحَرْفٍ منهما إلَّا أُعْطِيتَهُ

জিবরীল (আলাইহিস সালাম) নবী ﷺ-এর নিকটে উপবিষ্ট ছিলেন, ইত্যবসরে উপরের দিকে তিনি একটি আওয়াজ শুনতে পেয়ে নিজের মাথা তুললেন এবং বললেন, এটি আসমানের একটি দরজা যা আজই খুলে দেয়া হল; আজকের দিন ব্যতীত কখনও তা খোলা হয় নি। তখন সে দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা অবতরণ করলেন। তিনি বললেন, ইনি একজন ফেরেশতা যিনি পৃথিবীতে অবতরণ করলেন, আজ ছাড়া অন্য কখনো তিনি অবতরণ করেন নি। এরপর উক্ত ফেরেশতা সালাম করে বললেন, দুটি নূর এর সুসংবাদ গ্রহণ করুন যা আপনাকে দেয়া হয়েছে এবং যা আপনার আগে আর কোন নবীকে দেয়া হয় নি। তা হল সূরা ফাতিহা এবং সূরা বাকারা’র শেষাংশ। এ দু’ টির যে কোন হরফ আপনি পাঠ করবেন তা আপনাকে দিয়েই দেয়া হবে। (মুসলিম ৮০৬)

والله اعلم بالصواب