যে ব্যক্তি কোরআন হিফজ করার পর ভুলে গেছে তার কী হকূম?

জিজ্ঞাসা–৫৩২: আসসালামু আলাইকুম। কোরআন হিফজ করার পর যদি কেউ ভুলে যায় তাহলে তার ক্ষেত্রে মাসআলাটা কি? বিশেষ করে যারা প্রাপ্ত বয়সে যারা হিফজ সম্পন্ন করেন তাদের জন্য ইয়াদ ধরে রাখাটা খুবই কষ্টকর! ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, হিফজ করার পর ভুলে গেলে নাকি অনেক গুনাহ। সম্প্রতি কোনো এক মুফতির কাছ থেকে এমন শুনেছি যে, হিফজের পর কোরআন দেখে না পড়তে পারলে গুনাহ। বিস্তারিত জানানোর অনুরোধ রইলো।–আমাতুল্লাহ।

জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

এক: নিঃসন্দেহে কোরআন ভুলে যাওয়া গর্হিত কাজ। তাই রাসূলুল্লাহ্‌ বহু হাদিসে ভুলে যাওয়ার আশংকা রোধ করার জন্য নিয়মিত তেলাওয়াত করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। যেমন, এক হাদিসে তিনি বলেছেন,

مَثَلُ الَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَهْوَ حَافِظٌ لَهُ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ، وَمَثَلُ الَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَهْوَ يَتَعَاهَدُهُ وَهْوَ عَلَيْهِ شَدِيدٌ، فَلَهُ أَجْرَانِ

কোরআনের তেলাওয়াতকারী হাফেজ লিপিকর সম্মানিত ফেরেশতার মত। অতি কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যাক্তি বারবার কোরআন তেলাওয়াত করে, সে দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে। (বুখারী ৪৫৭৩)

দুই: কোরআন ভুলে গেলে ‘আমি ভুলে গেছি’ বলা উচিত নয়। বরং বলতে হয়, ‘আমাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে’। কেননা, হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ ‌ বলেছেন,

‏ بِئْسَمَا لأَحَدِهِمْ يَقُولُ نَسِيتُ آيَةَ كَيْتَ وَكَيْتَ بَلْ هُوَ نُسِّيَ اسْتَذْكِرُوا الْقُرْآنَ فَلَهُوَ أَشَدُّ تَفَصِّيًا مِنْ صُدُورِ الرِّجَالِ مِنَ النَّعَمِ بِعُقُلِهَا

যদি কেউ এভাবে বলে যে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গিয়েছি তাহলে তা তার জন্য খুবই খারাপ। বরং তাকে তো ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা কোরআনকে স্মরণ রাখ। কারণ কোরআন মানুষের হৃদয় থেকে পা বাঁধা পলায়নপর চতুস্পদ জন্তুর চেয়েও অধিক পলায়নপর। ছাড়া পেলেই পালিয়ে যায় অর্থাৎ স্মরণ রাখার চেষ্টা না করলেই ভুলে যায়। (মুসলিম ১৭২৬)

তিন: কোরআন ভুলে যাওয়ার হুকুম কি এ ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন,

ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, فإن نسيان القرآن من الذنوب কোরআন ভুলে যাওয়া গুনাহ। (মাজমু’উল ফাতাওয়া ১৩/৪২৩)

শায়খ জাকারিয়া আলআনসারি রহ. বলেন, অবহেলা ও অলসতার কারণে কোরআন ভুলে যাওয়া কবিরা গুনাহ। কেননা, রাসূলুল্লাহ্ ‌ বলেছেন,

عُرِضَتْ عَلَىَّ ذُنُوبُ أُمَّتِي فَلَمْ أَرَ ذَنْبًا أَعْظَمَ مِنْ سُورَةٍ مِنَ الْقُرْآنِ أَوْ آيَةٍ أُوتِيَهَا رَجُلٌ ثُمَّ نَسِيَهَا

আমার উম্মাতের গুনাহসমূহ আমাকে দেখানো হয়েছে। আমি তাতে কোরআনের কোন সূরাহ বা আয়াত শেখার পর তা ভুলে যাওয়ার চাইতে বড় গুনাহ আর দেখি নি। (আবু দাউদ ৪৬১ তিরমিযী ১৯৭৬ ইবনু খুযাইমাহ ১৯১৬)

مَا من امْرِئٍ يَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ ثُمَّ يَنْسَاهُ إِلَّا لَقِىَ اللّٰهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَجْذَمَ

যে ব্যক্তি কোরআন শিখে ভুলে গিয়েছে, সে কিয়ামাতের দিন অঙ্গহানি অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে। (আবু দাউদ ১৪৭৪ মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ ১০/৪৭৮)

সাহাবী আবূ ‘আলিয়্যাহ্ রাযি. বলেন,

كنا نعد من أعظم الذنوب أن يتعلم الرجل القرآن ثم ينام عنه حتى ينساه

আমরা সবচাইতে বড় গুনাহ বলে আখ্যায়িত করতাম কোন ব্যক্তির কোরআন শিক্ষা গ্রহণের পর অবহেলাবশত তা ভুলে গেলে। (ফাতহুল বারী ১১/২৮৫)

কারো কারো মতে, এটি এমন একটি মুসিবত যা বান্দার অন্তর ও দ্বীনদারিকে আক্রান্ত করে। এর ফলে বান্দার কোন কোন আমলের উপর আল্লাহর শাস্তি নামতে পারে। যদিও এটি কবিরা গুনাহ নয় বা পাপ নয়। (প্রাগুক্ত ৯/৮৬) কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ

তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। (সুরা শূরা ৩০)

চার: ‘ভুলে যাওয়া’ শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেছেন, المراد بالنسيان : أن لا يمكنه القراءة في المصحف দেখে দেখে তেলাওয়াত করার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলা। (মাতালিব উলিন্নুহা ১/৬০৪)

আর কোনো কোনো মুহাক্কিক ব্যাখ্যাকার ‘ভুলে যাওয়া’-এর ব্যাখ্যা করেছেন মুখস্ত পড়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলা। (বারীকা মাহমুদিয়া ৪/১৯৪)
ইমাম রাফি‘ঈ রহ. বলেন, কোরআন শিক্ষার বিভিন্ন ধরণ হতে পারে। যেমন দেখে পড়া, মুখস্থ রাখা, অর্থ বুঝা। যাই হোক না কেন তা ভুলে গেলে তার কাবীরাহ্ গুনাহ হবে। (ফাতহুল বারী ১১/২৮৫)

কেউ কেউ বলেন, النسيان بمعنى ترك العمل لا نسيانه بعد حفظه এখানে ভুলে যাওয়া মানে কোরআনের তিলাওয়াত ও তার প্রতি ‘আমাল থেকে বিরত থাকা। (আল ইস্তিযকার ২/৪৮৭)

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
আরো পড়ুন–
গোসল ফরয অবস্থায় অথবা বিনা অযুতে মনে মনে কোরআন পাঠ করা যাবে কি?
ওযু ছাড়া মোবাইলে কোরআন পড়া যাবে কি?
শিশু ওযু ছাড়াই কোরআন ধরতে পারবে কি?
কোরআনকে ‘কোরআন শরীফ’ বলা যাবে কি?
সূরাসমূহের নাম রেখেছেন কে?
ফেসবুকে কোরআন শরীফের ছবি আপলোড করা যাবে কিনা?
নাপাক অবস্থায় কোরআন স্পর্শ করলে কী হবে?
পোস্টার, মেমো ইত্যাদিতে বাংলা ভাষায় বিসমিল্লাহ লিখা যাবে কি?
সূরাসমূহের তারতিব রক্ষা না করা মাকরূহ–একথার দলিল কী?
রিংটোন হিসাবে আযান, তেলাওয়াত, জিকির, দোয়া ব্যবহার করা জায়েয কিনা?
কোরআন শরিফ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করার পর সেই কাজ আবার করলে কাফফারা দিতে হয় কিনা?
তেলাওয়াতের সময় আযান শুনলে কী করবে?
কোরআনের আইন বলতে কি বুঝায়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 − three =