জিজ্ঞাসা–৬০৩: আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় নয় বছর হয়েছে। আমাদের সন্তান হল, এক মেয়ে এক ছেলে। আমার স্বামী খুব বদমেজাজি। সামান্য কথার এদিক সেদিক হলেই আমার গায়ে হাত তোলে। এমনকি অনেক সময় গায়ে দাগ বসিয়ে দেয়। আমি এ নিয়ে খুব কষ্টে আছি। আমার পরিবারের লোকজন তাকে খুব ভালো জানে। তাই আমি এ বিষয়গুলো তাদের সঙ্গে শেয়ার করি না। কারণ, এতে তার সম্মান নষ্ট হবে। তাছাড়া আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে। আমি বিয়ের প্রথম প্রথম তাকে খুব ভালবাসতাম। এখন দিন দিন তার প্রতি আমার ভালবাসা কমে যাচ্ছে। আমি খুব কষ্টে আছি। কী করব বুঝতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার মত দুঃখী কেউ নেই। এজন্য নীরবে অনেক কান্নাকাটি করি। মনে হয়, সব কিছু ছেড়ে কোথাও চলে যাই কিংবা বিষ খেয়ে মরে যাই। কী করব; কোনো কুল-কিনারা পাচ্ছি না। প্লিজ আমাকে কিছু পরামর্শ দিন, আমাকে সাহায্য করুন।–নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
জবাব: প্রিয় বোন, আপনি সমস্যার যে বিবরণ দিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তা বেদনাদায়ক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান পরামর্শ এটাই হবে যে, আপনি আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করুন। কেননা, একমাত্র তিনিই পারবেন আপনার কষ্ট দূর করতে; আপনার পেরেশানিকে শান্তি দ্বারা ভরপুর করে দিতে।
আর আপনার প্রতি আমাদের আরো কিছু পরামর্শ হল–
— আপনার স্বামীর জন্য একজন উপদেশদাতার প্রয়োজন। সুতরাং যদি সম্ভব হয়, আপনার পরিচিত কারো মাধ্যমে আপনার স্বামীকে একজন আমলধারী আলেমের শরণাপন্ন করান; যিনি আপনার স্বামীকে হেকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে কিছু নসিহত করবেন। হতে পারে, এর মাধ্যমে তিনি নিজের ভুল বুঝতে সক্ষম হবেন।
— একটু ভেবে দেখুন তো, আপনার প্রতি আপনার স্বামী কর্তৃক স্থাপিত মুসিবতের পেছনে আপনিও কিছুটা দায়ী কিনা? কেননা, বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, যে স্ত্রীর যবান চলে বেশি, তার স্বামীর হাত চলে বেশি। যদি এমনটি হয় তাহলে যবান সংযত করার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সচেষ্ট হোন। স্বামীর রাগ ওঠে এমন কথা ও কাজ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।
— অনেক সময় পুরুষ তার চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। সুতরাং তিনি বিশেষ কাজে আহবান করলে আপনার সম্মতি যেন থাকে। প্রয়োজনে কৃত্রিমভাবে হলেও আপনি এবিষয়ে আগ্রহ বেশি দেখাবেন। দেখবেন, এটাও তার রাগ প্রশমনে খুব দ্রুত কাজ করবে।
— আপনি অবশ্যই মুসিবতে আছেন। কিন্তু আপনার চাইতেও বেশি মুসিবতে আছে, এ দুনিয়ায় এমন স্ত্রীও আছে। এমন নরপশুও তো আছে, যে স্ত্রীকে কেবল মারধোর করে না; বরং যৌতুকের দাবি নিয়ে স্ত্রীর পরিবারের জীবনকেও বিষিয়ে তোলে। মাতাল হয়ে এসে স্ত্রীর হাত পা ভেঙ্গে দেয়। এদের কথা ভাবুন, আপনার দুঃখ কিছুটা হলেও হালকা হবে।
— আপনার স্বামী যতই খারাপ হোক না কেন; নিশ্চয় তার মাঝে কিছু ভালো গুণও আছে। যেমন, হয়ত তিনি নামাযী, আপনার সন্তানদের প্রতি সহনাভূতিশীল। তাছাড়া আপনি বলেছেন, আপনার পরিবার তাকে ভালো জানে। এই ভালো জানারও তো কিছু কারণ অবশ্যই আছে। কিংবা অন্য কোনো গুণও তার মাঝে থাকতে পারে। সেগুলো দেখুন, এতে তার প্রতি আপনার অনাসক্তি কিছুটা হলেও কমবে। কিছুটা হলেও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হওয়া ভালোবাসা পুনরজ্জীবিত হবে।
— আপনার মুসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। দুনিয়ার জীবনে তিনি তাঁর বান্দাদিগকে পরীক্ষা করেন; এর মাধ্যমে তিনি দেখতে চান, বান্দা সবর করে কিনা? রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ : إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ
মুমিনের অবস্থা ভারি অদ্ভুত। তাঁর সমস্ত কাজই তাঁর জন্য কল্যাণকর। মুমিন ব্যাতিত অন্য কারো জন্য এ কল্যাণ লাভের ব্যাবস্থা নেই। তাঁরা আনন্দ (সুখ শান্তি) লাভ করলে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে, তা তাঁর জন্য কল্যাণকর হয়, আর দুঃখকষ্টে আক্রান্ত হলে ধৈর্যধারণ করে, এও তাঁর জন্য কল্যাণকর হয়। (মুসলিম ৭২২৯)
— আপনার প্রশ্নের বিবরণ থেকে বুঝা যাচ্ছে, আপনি মনের কথা সুন্দর করে গুছিয়ে লিখতে পারেন। সুতরাং আবেগ ও ভালোবাসাপূর্ণ কথা মিশিয়ে আপনার স্বামীর উদ্দেশ্যে দু’ এক পৃষ্ঠা লিখুন। আপনার লেখাটির কোনো এক ফাঁকে নিম্নের হাদিসগুলোকে স্থান দিন। তারপর তা আবেগঘন কোনো এক মুহূর্ত দেখে তাকে পড়তে দিন। এতে আল্লাহভীতির লেশমাত্রও যদি তার মাঝে থাকে তাহলেও তিনি সচকিত ও সতর্ক হবেন বলে আমরা আশা করছি।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
لَقَدْ طَافَ بِآلِ مُحَمَّدٍ نِسَاءٌ كَثِيرٌ يَشْكُونَ أَزْوَاجَهُنَّ لَيْسَ أُولَئِكَ بِخِيَارِكُمْ
আজ রাতে মুহাম্মাদের পরিবারে অনেক মহিলা এসে তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এসকল (মারপিটকারীরা) তোমাদের মধ্যে উত্তম লোক নয়। (আবু দাউদ ২১৪৬)
তিনি আরো বলেছেন,
أَلا وَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا فَإِنَّمَا هُنَّ عَوَانٌ عِنْدَكُمْ لَيْسَ تَمْلِكُونَ مِنْهُنَّ شَيْئًا غَيْرَ ذَلِكَ إِلاّ أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ فَإِنْ فَعَلْنَ فَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلا أَلا إِنَّ لَكُمْ عَلَى نِسَائِكُمْ حَقًّا وَلِنِسَائِكُمْ عَلَيْكُمْ حَقًّا فَأَمَّا حَقُّكُمْ عَلَى نِسَائِكُمْ فَلا يُوطِئْنَ فُرُشَكُمْ مَنْ تَكْرَهُونَ وَلا يَأْذَنَّ فِي بُيُوتِكُمْ لِمَنْ تَكْرَهُونَ أَلا وَحَقُّهُنَّ عَلَيْكُمْ أَنْ تُحْسِنُوا إِلَيْهِنَّ فِي كِسْوَتِهِنَّ وَطَعَامِهِنَّ
শোন, তোমরা স্ত্রীদের কল্যাণের ওয়াসীয়ত গ্রহণ কর। তারা তো তোমাদের কাছে বন্দী। তা ছাড়া আর কোন বিষয়ে তোমরা তাদের মালিক নও। কিন্তু তারা যদি সুষ্পষ্ট অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয় তবে ভিন্ন কথা। তারা যদি তা করে তবে তাদের শয্যায় তাদের আলাদা রাখবে, মৃদু প্রহার করবে, কঠোরভাবে নয়। তারপর তারা যদি তোমাদের আনুগত্য করে তবে আর তাদের বিরুদ্ধে উত্যক্ত করার জন্য পথের খোঁজ করবে না। সাবধান! তোমাদের স্ত্রীদের তোমাদের হক রয়েছে আর তোমাদের স্ত্রীদেরও তোমাদের উপর হক রয়েছে। স্ত্রীদের উপর তোমাদের হক হলো, যাদের তোমরা অপছন্দ কর, তাদের তোমাদের ঘরে স্থান দিবে না অথবা যাদের তোমরা অপছন্দ কর, তাদের গৃহে অনুমতি দিবে না। শোন, তোমাদের উপর স্ত্রীদের হক হলো, তাদের খোর পোষের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি উত্তম আচরণ করবে। (তিরমিযি ১১৬৩)
— যদি মারধোর করে দাগ তৈরি করে দেয় তাহলে যখন পরবর্তীতে তার রাগ পড়ে যাবে তখন দাগগুলো তাকে দেখাবেন এবং নম্রতা ও ভালোবাসার সুরে তার বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখবেন, তার সন্তানের মা আপনি আর আপনার সঙ্গে এমনটি করা তার জন্য উচিত হয়েছে কিনা? আশা করি, বিবেকবান হলে তিনি কিছুটা হলেও ব্যথিত হবেন। যদি দেখেন যে, তিনি তার অপরাধ বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, তখন আরো ন্রমতার সঙ্গে তাকে বুঝাবেন যে, জুলুম করা কবিরা গুনাহ। মজলুমের বদদোয়া আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেন। আমার শরীরেরও তো দোয়া-বদদোয়া আছে। এতে আমাদের উভয়ের সন্তানের ক্ষতি হবে।
— প্রিয় বোন, যদি আপনি উক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারেন এবং পাশাপাশি আল্লাহর কাছেও দোয়াও অব্যাহত রাখেন তাহলে আমরা আশা করছি যে, তখন আল্লাহর রহমত আসবে। ফলে আপনার স্বামীর মনুষ্যত্ব জেগে উঠবে এবং তিনি আপনার প্রতি সদয় হবেন।
— তবে অনেক সময় দেখা যায়, দাম্পত্যজীবনের সমস্যাগুলো খুব দ্রুত সমাধানে আসে না। বরং ছেলে-মেয়ে বড় হতে হতে সমস্যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। বেশি হারে ইস্তেগফার পড়ুন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِب
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
আরো পড়ুন– ☞ প্রবাসী স্বামী মায়ের কথা শুনে যোগাযোগ করে না; কী করব? ☞ স্বামী স্ত্রীর মাঝে আদর্শিক দ্বন্দ্ব; তাহলে কি তালাকের উপদেশ দিব? ☞ আমার স্বামী ভাল মানুষ; কিন্তু নামাজ পড়ে না; কী করব? ☞ স্ত্রীর হায়েজ বা নেফাস অবস্থায় স্বামীর চাহিদা পূরণ করার উপায় আছে কি? ☞ স্বামী যদি স্ত্রীর চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার হুকুম কী? ☞ মা-বাবার খরচ চালানো দায়িত্ব ছেলে না মেয়ের এবং স্বামীর অবাধ্য হয়ে মায়ের দেখাশোনা করা যাবে কি? ☞ সব নারীই কি নিজের স্বামীর হাড় থেকে সৃষ্ট? ☞ ☞ স্বামী-স্ত্রী কে কোন পাশে ঘুমাবে? ☞ রুমে কেবল স্বামী স্ত্রী থাকলে বস্ত্রহীন হয়ে কি ঘুমানো যায়? ☞ ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর জান্নাত’ কথাটা সত্য কিনা? ☞ বৌয়ের দুধ স্বামীর মুখে দিতে পারবে কি? ☞ স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের লজ্জাস্থানে মুখ লাগানোর হুকুম ☞ স্ত্রীকে বোন,স্বামীকে ভাই বলে সম্বোধন করা যাবে কি? ☞ নারীর রূপচর্চা : বৈধতা ও অবৈধতার সীমারেখা ☞ বড়দের ঝগড়ার কারণ ও প্রতিকার ☞ যবান সামলান! ☞ সংসার সুখের হয় দু’জনের গুণে ☞ স্ত্রীর হাতে সংসারের খরচের সব টাকা তুলে দেয়া যাবে কি? ☞ প্রিয় বোন! কেন পর্দা করবেন? ☞ হিজাবের বৈশিষ্ট্যাবলি