জিজ্ঞাসা-৪৮: আসসালামু আলাইকুম।। আমার জিজ্ঞাসা করার বিষয় হলো। জুমআ’র খুতবাহ মাতৃভাষায় দেওয়া যায়েয হবে কি ? এক ভাই বলেছেন ইমাম আবু হানিফার মতে দেওয়া যায়েয হবে। উনি দলীল পেশ করেছেন ( রাদ আল- মুহতার, ১/৫৪৩) এটা কি সহীহ কিনা? যদি সহীহ না হয় তাহলে সঠিক তথ্যটি বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।–আহমাদ ইবনে সুলতান।
জবাব:ওয়ালাইকুমুস সালাম ওরাহমাতুল্লাহ। আপনার উল্লেখিত ভাইয়ের কথা সহিহ কিনা-এই উত্তর দেয়ার আগে একটি সমস্যার উল্লেখ করছি। তাহল, মনে করুন , একটি মসজিদে জুমআ’র দিন খুতবার সময় কিছু ইংরেজি ভাষী, কিছু উর্দূ ভাষী, কিছু ফারসী ভাষী, কিছু আরবী ভাষী ও কয়েকজন বাংলা ভাষী মুসল্লি উপস্থিত রয়েছেন। এমতাবস্থায় খতীব সাহেব শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কাদের মাতৃভাষায় খুতবা পেশ করবেন? আল্লাহ তাআলা সবাইকে সহীহ বুঝ দান করুন ।
মূলত আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় খুতবা প্রদান করা বিদআত ও মাকরূহে তাহরীমি। কারণ তা রাসূলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবেতাবেঈন এবং গোটা মুসলিম উম্মাহর সর্বযুগে সর্বসম্মত আমলের (সাবীলুলমুমিনীন-মুমিনদের পথ) পরিপন্থী। উপমহাদেশের বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) তাঁর রচিত মুয়াত্তায়ে মালেকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মুসাফফায় উল্লেখ করেনঃ
لما لا حظنا خطبة النبى صلى الله عليه وسلم وخلفائه رضى الله عنهم وهلم جرا فنجد فيها وجوذ اشياء، منها الحمد والشهادتان والصلاة على النبى صلى الله عليه وسلم والامر بالتقوى وتلاوة آية والدعاء للسملمين والمسلمات وكون الخطبة عربية
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (সা.), খুলাফায়ে রাশেদীন, তাবেঈন, তাবেতাবেঈন এবং পরবর্তী যুগের ফুকাহায়ে কেরাম ও উলামায়ে দ্বীনের খুতবাসমূহ লক্ষ করলে দেখা যায় যে তাঁদের খুতবায় নিম্মের বিষয়গুলো ছিল। যথা : আল্লাহ তাআলার হামদ , শাহাদাতাইন (অর্থাৎ তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা) রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরূদ, তাকওয়ার আদেশ, পবিত্র কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত, মুসলমানদের জন্য দুআ। তাঁরা সকলেই আরবী ভাষায় খুতবা দিতেন। গোটা মুসলিম বিশ্বের বহু অঞ্চলের ভাষা আরবী নয়, তবুও সর্বত্র আরবী ভাষায়ই খুতবা দেওয়া হতো। (মুসাফফা, ১/১৫৪)
বলা হয়ে থাকে,ইমাম আবু হানীফা (রহ.) আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা দেওয়া বৈধ বলেছেন। অথচ ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতে খুতবা অনারবী ভাষায় দেওয়া জায়েয দ্বারা উদ্দেশ্য হল, মাকরূহে তাহরীমির সাথে জায়েয। কারণ,ফিকহে হানাফীর অধিকাংশ কিতাবেই স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, আবু হানীফা (রহ.)-এর মতে অনারবী ভাষায় খুতবা জায়েয দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মাকরূহে তাহরীমির সাথে জায়েয।(শামী, ২/১৮৩, বাহরুর রায়েক , ১/ ৫৩৫ , তাতারখানিয়া, ২/৭৪, সিআয়া, ২/১৫৫)
অতএব, অনারবী ভাষায় খুতবা প্রদান করার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতটিকে দলিল হিসেবে পেশ করা একেবারে অযৌক্তিক এবং খেয়ানতও নয় কি!
উল্লেখ্য, খুতবাকে ওয়াজ বা বক্তৃতা মনে করাটাও ভুল। কারণ,ওয়াজ বা বক্তৃতাকে আরবীতে ‘তাযকীর ’ বলা হয় । অথচ কোরআন-সুন্নাহ্ য় খুতবাকে ‘যিকর’ বলা হয়েছে। (দেখুন, সূরা জুমআহ, আয়াত – ৯ , বুখারী ,হাদীস-৩০১, মুসলিম, হাদীস-৮৫০, নাসায়ী, হাদীস-১৩৮৬, ইবনে মাযাহ, হাদীস-১০৯২,(فَإِذَا خَرَجَ الإِمَامُ حَضَرَتِ المَلاَئِكَةُ يَسْتَمِعُونَ الذِّكْرَ)তাফসীরে রুহুল মাআনী, ১৩/৭০২,আত-তাফসীরুল কাবীর ৯/৩০আহকামুল কোরআন ৩/৫৯৬তাফসীরে ইবনে কাসীরে ৯/ ৪৫৬)
ফুকাহায়ে কেরামও খুতবাকে ওয়াজ বা বক্তৃতা বলেননি বরং খুতবাকে দুই রাকআত নামাযের স্থলাভিষিক্ত বলেছেন। (বাহরুর রায়েক, ২/১০৮) হযরত উমর (রা.)সহ বিভিন্ন সাহাবা থেকেও এরূপ বর্ণিত আছে।যেমন-
عن عمر بن الخطاب قال: كانت الجمعة اربعا فجعلت ركعتين من أجل الخطبة
অর্থ: হযরত উমর (রা.) বলেন, জুমু’আর নামায চার রাক’আত ছিল। এরপর খুতবার কারণে দুই রাক’আত করা হয়েছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, হাদীস-৫৩৩১)সুতরাং খুতবাকে ওয়াজ বা বক্তৃতা মনে করা মূর্খতা বৈ কিছু নয়।
মূর্খতার আরেকটি রূপ হল, একথা বলা যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আরবী ভাষায় খুতবা দেননি। বরং মাতৃভাষায় খুতবা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের মাতৃভাষা আরবী ছিল, এ জন্য তাঁরা আরবী ভাষায় খুতবা দিতেন।
মূলত যুক্তিটি নামায, তেলাওয়াত, আযান ও ইকামতের ব্যাপারেও পেশ করা যেতে পারে। তাহলে কি ওই সব ইবাদতগুলোও রাসূলুল্লাহ (সা.) মাতৃভাষায় আদায় করেছেন বলে যুক্তি দেখিয়ে অন্যরা মাতৃভাষায় আদায় করলে সহীহ হবে? আল্লাহর কাছে পানাহ চাই;আসলে মূর্খদের এসব যুক্তি ইবাদত নিয়ে খেল-তামাশারই অন্তর্ভুক্ত।
মনে রাখবেন,খুতবা ইসলামের একটা প্রতীক অর্থাৎ আযান,ইকামাত, নামাজ, তাকবির এগুলো যেমন ইসলামের প্রতীক তেমনি খুতবাও একটি প্রতীক । আযান ইকামাত যেমন অন্য ভাষায় দেওয়া যায় না তেমনি খুতবাও অন্য ভাষায় দেওয়া যাবেনা। এজাতীয় যুক্তি চলতে থাকলে আজ খুতবা বাংলায় দেওয়ার দাবী উঠছে কাল নামাজ বাংলায় করার দাবী উঠবে। যারা এ বিদআতি কাজটি করে যাচ্ছে, তাদের কাছে এ বিষয়ে রাসুল (সাঃ) থেকে এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে সহীহ হাদীসের দলীল চান। তাহলেই দেখবেন, দলীল নয় মনের খাহেশাতই হচ্ছে তাদের দলীল।
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
আরো পড়ুনঃ সহীহ হাদীসের আলোকে কাবলাল জুমআ’ ও বা’দাল জুমআ’