শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
হামদ ও সালাতের পর!
আল্লাহ তা’আলা নিজেদেরকে সংশোধন করার উদ্দেশ্যে তাঁরই জন্য কিছু সময় বের করার তাওফিক আমাদেরকে দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
রাস্তা তামাশার জায়গা নয়
গতকালের মজলিসে আসক্তি, আসক্তির ভয়াবহতা এবং আসক্তির কারণগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, একজন মানুষ যেকোনো একটি গুনাহতে আসক্ত হওয়ার প্রথম ও প্রধান কারণ হল, ঈমানের দুর্বলতা। দ্বিতীয় কারণ হল, অসৎ সঙ্গ। তৃতীয় কারণ হল, দৃষ্টির হেফাজত না করা। চতুর্থ কারণ হল, বেকারত্ব। আর আসক্তির ষষ্ঠ কারণ হল, রাস্তার হক পূরণ না করা । একজন একটু হু করে উঠেছে আর তা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে গেছে । একজন তামাশা করছে তো অন্যরা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে গেছে । রাস্তা তামাশার জায়গা নয় । আবু সাইদ খুদরি রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
إيَّاكُم و الجلوسَ في الطُّرُقاتِ قالوا يا رسولَ اللهِ ما لنا بُدٌ من مجالِسِنا نَتحدَّثُ فيها ، فقال ﷺ : أما إذا أَبيتُمْ ، فَأَعطُوا الطَّريقَ حَقَّهُ قالوا : و ما حَقُّ الطَّريقِ يا رسولَ اللهِ ؟ قال : غَضُّ البصرِ ، و كَفُّ الأذَى ، و الأَمرُ بالمعروفِ ، و النَّهيُ عنِ المنكَرِ
তোমরা রাস্তার উপর বসা ছেড়ে দাও। লোকজন বলল, এ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। কেননা, এটাই আমাদের উঠাবসার জায়গা এবং এখানেই আমরা কথাবার্তা বলে থাকি। তিনি বলেন, যদি তোমাদের সেখানে বসতেই হয়, তবে রাস্তার হক আদায় করবে। তারা বলল, রাস্তার হক কি? তিনি বললেন, দৃষ্টি অবনমিত রাখা, কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা, সালামের জওয়াব দেওয়া, সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করা। (সহীহ বুখারী ২৪৬৫ সহীহ মুসলিম ৫৩৮০ )
রাস্তায় আড্ডা দিবে তো বদনজর পড়ে যাবে। এবার এটা মাথায় কিলবিল করবে। শয়তান ওয়াসওয়াসা দিবে। আর এই ওয়াসওয়াসাকে চরিতার্থ করার জন্য যুবক হয়তো গুগলে সার্চ দিবে, পর্ন দেখবে, মাস্টারবেশন করবে। ধীরে ধীরে এডিক্টেড হয়ে যাবে। তাহলে শুরুটা হয়েছে রাস্তা থেকে। রাস্তার হক পূরণ না করা এটাও আসক্তির একটা কারণ ।
মৌলভি সাহেবের শয়তান মৌলভি টাইপের হয়
আমরা উক্ত ৬টি কারণ সম্পর্কে আলাহামদুলিল্লাহ বিস্তারিত ভআলোচনা করেছি। আমরা কেউই বলতে পারব না যে, আমরা আসক্তি থেকে মুক্ত। সাধারণ মানুষের শয়তান সাধারণ টাইপের। আর মৌলভি সাহেবের শয়তান মৌলভি টাইপের।
قُلْ كُلٌّ يَعْمَلُ عَلَى شَاكِلَتِهِ
প্রত্যেকেই আপন স্বভাব অনুসারে কর্ম সম্পাদন করে থাকে। (সূরা আল-ইসরা ৮৪)
আমরা কেউ কুদৃষ্টিতে, কেউবা সিরিয়ালে, কেউবা হারাম ইনকামে আসক্ত। কিন্তু সকলেই আসক্ত। অর্থাৎ প্রত্যেকেই আপন স্বভাব অনুসারে আসক্ত।
যে জাতীয় গুনাহর কারণে বেশি মানুষ জাহান্নামে যাবে
আমরা এও আলোচনা করেছিলাম যে, মানুষ হঠাত হয়ে যাওয়া গুনাহের কারণে জাহান্নামে যাবে কম। জাহান্নামে বেশি যাবে ঐ সকল গুনাহের কারণে যেগুলো আসক্তির পর্যায়ে। হঠাত যে সকল গুনাহ হয়ে যায় সেগুলো বিভিন্ন নেক কাজের দ্বারা , তাওবার দ্বারা সহজে মাফ হয়ে যায় । আল্লাহ কেবল ইনসাফগারই নন দয়াবানও । ২-১ টি গুনাহ হয়ে গেছে আর আল্লাহ তাকে জাহান্নামে দিয়ে দিবেন এমন নন । আল্লাহ বলেন ,
بَلَىٰ مَن كَسَبَ سَيِّئَةً وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
হাঁ, যে ব্যক্তি গুনাহ করে এবং সেই গুনাহ তাকে ঘিরে নিয়েছে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী। সেটি তাদের স্থায়ী আবাস। (সূরা বাকারা ৮১)
গুনাহ যখন মানুষকে ঘিরে ফেলে তখন একটা সময় সে গুনাহের বৈধতা খুঁজে বেড়ায়। ধীরে ধীরে সে হারামকে হালাল করতে শুরু করে। এভাবে একটা পর্যায়ে সে ঈমানটা হারিয়ে ফেলে এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামের উপযুক্ত হয়ে যায়।
আমরা যারা এখন কথাগুলি শুনছি, আমরা নিজেদের অবস্থা আশা করি বুঝতে পারছি। যদি জাহান্নামে যাওয়া হয় (আল্লাহ হেফাজত করুন ) তাহলে কোন গুনাহটার কারণে জাহান্নামে যাব তা বুঝতে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা না।
এটারও শোকর আদায় করেন যে, আল্লাহ তাআলা আমাকে আপনাকে রোগ ধরার তৌফিক দান করেছেন। দ্বীনে মজলিসে বসার এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ লাভ যে নিজের দোষ ধরার তৌফিক দান করেন । আল্লাহ যাদের ব্যাপারে কল্যাণ চান তাদেরকেই নসিহত শুনার তৌফিক দান করেন ।
আজকে আমরা আসক্তির চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করব। চিকিৎসার দুইটা পদ্ধতি। একটা হল মৌলিক চিকিৎসা । আরেকটা হল নগদ চিকিৎসা। মৌলিক চিকিৎসা আগে বলি চিকিৎসা চলাকালীন যে ব্যক্তি যে গুনাহে আসক্ত সে গুনাহ তার হয়ে যেতে পারে। তবে মাত্রাটা ধীরে ধীরে কমে আসবে। আমি বলছি না যে, সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। এটা সম্ভবও না।
আসক্তির প্রথম চিকিৎসা: নেক মজলিসে শরীক হওয়া
মৌলিক চিকিৎসার প্রথমটি হল, নেক মজলিসে শরীক থাকা। নেক মজলিসে থাকার ফায়দা হল ধীরে ধীরে চিন্তার জগত পরিবর্তন হতে থাকে। আপনারা যারা ইতেকাফে ছিলেন এর প্রভাবে আপনারা দুই, চার ,পাঁচ মাস অনুভব করবেন। আগে হয়ত একটা গুনাহ করার আগে কোন চিন্তা মাথায় আসত না এখন অন্তত মনটা খচখচ করবে। নেক মজলিসের প্রভাব কি? রাসুলুল্লাহ ﷺ হাদিসে বলেন,
هُمُ القَومُ لاَ يَشْقَى بِهِمْ جَلِيسُهُمْ
তারা সেই সম্প্রদায়, তাদের সাথে যে বসে সেও বঞ্চিত হয় না। (সহীহুল বুখারী ৬৪০৮ মুসলিম ২৬৮৯ তিরমিযী ৩৬০০, আহমাদ ৭৩৭৬, ৮৪৮৯, ৮৭৪৯ )
একজন মানুষের সবচেয়ে বড় হতভাগ্য হল ঈমানহারা হওয়া । তাহলে নেককারদের মজলিসে বসলে সে ঈমানহারা হয় না ।
মনে রাখবেন, সোহবত এমন এক আমল যার কোন বিকল্প নেই। আপনি দ্বীনের যে খেদমতই করেন না কেন আপনার সোহবত এখতিয়ার করা উচিত । আল্লামা আলুসি বাগদাদি রহিমাহুল্লাহ বলেন, যদি তুমি গোপন গুনাহ থেকে বাচতে চাও, তবে তোমাকে একজন আল্লাহওয়ালার সোহবত এখতিয়ার করতে হবে ।
আল্লাহর এক আরেফ বলেন,
دم کے دم میں قلب نورانى ہوئى * مرد حق سے ملكےحقانى ہوئى
আমাদের কিছু ধোঁকাবাজিপূর্ণ কথা
আমরা কিছু ধোঁকাবাজিপূর্ণ কথা বলি। আমরা ইলম শিখলে বলি, ইলম তো শিখেছি আল্লাহওয়ালার কাছে আবার যাওয়ার দরকার আছে নাকি! চিল্লা দিলে বলি, তাবলীগ করলেই হবে আল্লাহওয়ালা বুজুর্গদের কাছে আবার যাওয়ার কী দরকার! কিন্তু আপনারা একটু ভেবে দেখুন, ইসলাম কি এই শিক্ষা দেয় যে, নেককার লোকদের মজলিসে যাওয়ার প্রয়োজন নাই? না ইসলাম এটা শিক্ষা দেয় যে, নেককার লোকদের সাথে চলাফেরা করতে হবে, সুসম্পর্ক রাখতে হবে?
সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আ’নহুম , তাবেইন, তাবে তাবেইন তাঁরা আমাদের আদর্শ। তাঁদের সবাই তো নেককার ছিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে যারা অধিক মুত্তাকী ছিলেন তাঁদের ব্যাপারে তাঁদের নীতি কি ছিল? কাছে যাওয়া না দূরে থাকা?
সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আ’নহুম ইসলাম গ্রহণের আগে অনেক খারাপ ছিলেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর যে তারা এত ভাল হলেন তা কিভাবে হয়েছে? রাসূল ﷺ-এর সোহবত তাঁদের জন্য এই মাকামে এনে দিয়েছে। মুফতি শফি রহিমাহুল্লাহ বলেন, নবুওয়াতের পর যদি সোহবতের চাইতে দামি কিছু থাকত তাহলে সাহাবীদের নাম সাহাবী না হয়ে অন্য কিছু হত ।
সোহবত ও জিকির যাদের কাছে অপ্রিয়
যাদের তাকদিরে হেদায়াত নাই তারা সোহবত দেখতে পারে না। আর জিকির দেখতে পারে না। অথচ এই দুইটার মাঝে রয়েছে সব রোগের মৌলিক চিকিৎসা। একটা আরেকটার স্থলাভিষিক্ত। সোহবত কম হলে জিকির বেশি কর। জিকির কম সোহবত বেশি নাও। আর যদি দু’টাই করতে পার তবে তো নূরুন আ’লা নূর। বাংলায় যাকে বলে, সোনায় সোহাগা!
একজন তাবলীগ করে কিন্তু আলেম-ওলামা দেখতে পারে না, খোঁজ নিলে দেখবেন সোহবত নাই । একজন মুজাহিদেরও যদি চরিত্রে সমস্যা পান তাহলে খোঁজ নিয়ে দেখবেন সোহবত নাই। কিন্তু এসব বললে আপনারা মনে করেন আপনাদের বিরুদ্ধে বলি। এই যে মনে কষ্ট নেন এটাও মূলত সোহবতের অভাব। আমি সোহবতের জরুরতের কথা বলছি তাবলীগ, জিহাদ কিংবা ইলমের অন্য কোন খেদমতের বিরুদ্ধে বলছি না। এগুলো তো সবই আপন স্থানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
আমি আপনাকে এ কথা বলি না যে ঢালকানগর যান, যাত্রাবাড়ী হুজুরের কাছে যান। আমি বলছি, আপনি যেখানেই দ্বীনের কাজ করেন সেখানেই কোন দ্বীনদার মুত্তাকী বুজুর্গ আলেমের তত্বাবধানে থাকবেন। অন্যথায় আপনার দ্বীনের কাজ রঙঢং হবে, প্রকৃত দ্বীন হবে না ।
নাপাক জমিন দুইভাবে পাক হয়
নাপাক জমিন দুইভাবে পাক হয়। এক হল পানিতে নাপাকি ধুয়ে গেলে, আরেক হল রোদে নাপাকির আছর সম্পূর্ণ চলে গেলে । জিকির হল পানি দ্বারা ধৌত করার মত। আর সোহবত হল সূর্যের আলোর মত। আপনি একজন আল্লাহওয়ালার সামনে ৫ মিনিট বসলে অন্তরের যে পরিবর্তন হবে তা অনেক আমল করেও হবে না। সাহাবায়ে কেরাম বলতেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মজলিসে বসতাম তখন আমাদের দিল পরিবর্তন হয়ে যেত।
নেককারদের মজলিসে বসার সওয়াব
নবীজী ﷺ বিভিন্ন আমলের ফযীলত বর্ননা করেছেন গুনাহ মাফের অনেক আমলের কথা বলেছেন। এক মজলিসে ৪০ টা গুনাহ মাফের আমলের কথা আপনাদের শুনিয়েছিলাম। আরও আছে। কিন্তু গুনাহ মাফ, আবার গুনাহের পরিবর্তে নেক আমল এরকম আমল হাতেগোনা। আর তা হল নেককারদের মজলিসে বসার সওয়াব । আনাস রাযি. বলেন, রাসূল ﷺ বলেন
ما مِنْ قَوْمٍ اجْتَمَعُوا يَذْكُرُونَ اللهَ، لا يُرِيدُونَ بِذَلِكَ إلَّا وَجْهَهُ، إلَّا ناداهُمْ مُنادٍ مِنَ السَّماءِ: أَنْ قُومُوا مَغْفُورًا لَكُمْ، قَدْ بُدِّلَتْ سَيِّئاتُكُمْ حَسَناتٍ
যে কোনো সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে আল্লাহর জিকির করবে এবং এর দ্বারা তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন, সেই সম্প্রদায়কে আসামানের কোনো এক ঘোষণাকারী ডেকে বলবে, তোমরা এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে যাও যে, তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে এবং তোমাদের গুনাহসমূহকে পরিবর্তন করে সাওয়াবে পরিণত করা হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ ১২৪৫৩)
আসক্তির দ্বিতীয় চিকিৎসা: আল্লাহর জিকির করা
অনুরূপভাবে আসক্তির আরেকটি চিকিৎসা হল, আল্লাহর জিকির করা। সব ধরণের জিকির দ্বারাই অন্তর পরিষ্কার হয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অন্তর পরিষ্কার হয় কুরআন তেলাওয়াত দ্বারা। আমাদের অনেক দ্বীনদার ভাই আছেন দ্বীনের জন্য কুরবান হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু কুরআনটা সহীহ করেন না। দ্বীনের কাজে অনেক টাকা পয়সা খরচ করেন কিন্তু কুরআন সহীহ করেন না। কেমন যেন এটা দ্বীনের কোন কাজ না। আল্লাহর কসম, আকাশের নিচে জমিনের উপরে কুরআন সহীহ করার চেয়ে উত্তম মজলিস আর নাই। আব্দুল কাদের জিলানীর মজলিসও না, বায়েজিদ বোস্তামির মজলিসও না।
কুরআনের আশ্চর্য প্রভাব!
আপনি একটা ছেঁচড়া- ছেলেকে ধরে আনেন। তাকে বলেন, তুমি তো মুসলমান?
–হ্যাঁ মুসলমান ।
–নামাজ তো পড়া লাগবে?
–হ্যাঁ লাগবে, কিন্তু কিছু পারি না।
–কুরআন তো দেখেছ?
–হ্যাঁ দেখেছি।
–কুরআন তো শিখা লাগবে?
–হ্যাঁ লাগবে।
–তাহলে তোমার কিছু করার দরকার নাই। তুমি শুধু প্রতিদিন আধা ঘণ্টা সময় দিয়ে কুরআনটা শিখবে ।
আপনি তাকে এভাবে কুরআন শিখানোর মজলিসে বসিয়ে দেন। তার হাতে কুরআনটা তুলে দেন। সূরা ফীল থেকে শুরু করে সূরা নাস এ যাওয়া লাগবে না। একটা দুইটা সূরা শিখার পড়েই আপনি দেখবেন যে, সে নামাজ শুরু করে দিয়েছে। কুরআনের এক মজলিসে যে পরিবর্তন হবে এরকম হাজার মজলিসে চিন্তার জগতে সে পরিবর্তন আসবে না।
অন্তরকে পাক করার মাজুনি হল আল্লাহর জিকির
কুরআনের নূর এমন এক নূর এর মোকাবেলায় জগতের আর কিছু নাই। কারণ এটা আল্লাহর কালাম। একেকটি আয়াত, একেকটি হরফ আপনার দিলে পড়বে আপনার দিলের জং দূর হতে থাকবে। এটা আমার কথা না। বরং নবীজী ﷺ এক হাদিসে সকল জিকির সম্পর্কে বলেছেন,
لِكُلِّ شيْءٍ صِقَالَةٌ وصِقالُ القلوبِ ذكْرُ اللهِ
নিশ্চয় প্রত্যেক জিনিসকে পাকসাফ করার একটা মাজুনি আছে। আর অন্তরকে পাক করার মাজুনি হল আল্লাহর জিকির। (কানযুল উম্মাল ১৮৪৮)
আর সকল আলেমের মতে জিকিরের মধ্যে কুরআন তেলাওয়াত হল সর্বোত্তম। তাই নবীজী ﷺ কুরআন তেলাওয়াত সম্পর্কে বিশেষভাবে বলেছেন যে, এটি অন্তরের মরিচা দূর করে। আবদুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজী ﷺ বলেন,
إِنَّ هَذِهِ الْقُلُوبَ تَصْدَأُ كَمَا يَصْدَأُ الْحَدِيدُ إِذَا أَصَابَهُ الْمَاءُ . قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا جِلَاؤُهَا؟ قَالَ: كَثْرَةُ ذِكْرِ الْمَوْتِ وَتِلَاوَةِ الْقُرْآنِ
নিশ্চয় অন্তরে মরিচা ধরে, যেভাবে পানি লাগলে লোহায় মরিচা ধরে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রসূল! এ মরিচা দূর করার উপায় কী? তিনি (ﷺ) বললেন, বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করা ও কুরআন তিলাওয়াত করা। (শু‘আবূল ঈমান ১৮৫৯)
জিকরে-কালবি অন্তর পরিষ্কার করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম
জিকিরের মধ্যে অন্তর পাক করার দ্বিতীয় শক্তিশালী আমল হল জিকরে-কালবি। কারণ সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হল কলবে। কলবে বা অন্তরে নানা চিন্তার উদ্রেক হয়। মনে হচ্ছে গুগল সার্চ মারি, মনে হচ্ছে এই বারের জন্য হারাম টাকাটা নিয়ে নেই। মনে হচ্ছে গেমস খেলি। এইভাবে কলবে নানা চিন্তার উদ্রেক হয়। কলব সব সময় একটা না একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই কলবের খাদ্য পরিবর্তন করতে হবে। হয়ত তাকে নেক আমলের চিন্তা দিতে হবে অন্যথায় সে গুনাহের চিন্তা করবে। এখন অন্তরকে এত নেক আমলের চিন্তা কিভাবে দিবেন। হজ্জ করব , হজ্জ করব এটা দশ বার না হয় বললেন, এগারবার বলতে মনে চাইবে না । ইলম শিখব, ইলম শিখব বিশ বার না হয় বললেন, এর পর আর মনে চাইবে না। এজন্য বলা হয়, অন্তরকে একটা সহজ জিকির দিয়ে দাও যেন সে সব সময় করতে পারে। এই সহজ জিকিরটি হল, আল্লাহ আল্লাহ। অন্তর যখন আল্লাহ আল্লাহ বলাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখন বাহ্যিক দৃষ্টিতে হয়তো সে কাজে ব্যস্ত থাকবে কিন্তু তার অন্তর থাকবে আল্লাহর সাথে। কবির ভাষায়,
دنیا کی مشغلوں میں بہی با خدا رہے * سب کے ساتھ رہکر بھی سب سے جدا رہے
দুনিয়ার শত ব্যস্ততার মাঝেও সে আল্লাহ্র সঙ্গে থাকে। সকলের সঙ্গে থেকেও সে সকল থেকে আলাদা থাকে।
এটাকে বলা হয়, দাস্ত ব-কার দিল ব-য়ার। হাত কাজে ব্যস্ত, অন্তর বন্ধুর সঙ্গে। হযরত রাবেয়া বসরি রহ. বলতেন, আমার জবান যখন মানুষের সাথে কথা বলে তখন আমার দিল কথা বলে আল্লাহর সাথে।
অন্তরের জিকিরের ফজিলত
তো যেটা বলতে চাচ্ছিলাম যে, অন্তরকে পরিষ্কার করার দ্বিতীয় আমল হল জিকির। আর জিকিরের মাঝে প্রথম হল কুরআন তেলাওয়াত। এটা সহজ। যত বড় আসক্তির রোগীই হোক তাকে এ কথা খাওয়ানো সহজ যে, ভাই, কুরআনটা সহীহ কর। কুরআন সহীহ কর–এ কথা খাওয়ানো যত সহজ, ভাই তুমি জিকিরে কালবি কর, চিল্লা দাও এ কথা খাওয়ানো তত সহজ নয়। দ্বিতীয় হল জিকিরে কালবি । রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হাদিসে কুদসি–
أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِيْ بِيْ، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي، فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ، ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي، وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلأٍ ذَكَرتُهُ فِي مَلأٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ
আমি আমার বান্দার ধারণার পাশে থাকি। (অর্থাৎ সে যদি ধারণা রাখে যে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন, তার তওবা কবুল করবেন, বিপদ আপদ থেকে উদ্ধার করবেন, তাহলে তাই করি।) আর আমি তার সাথে থাকি, যখন সে আমাকে স্মরণ করে। সুতরাং সে যদি তার মনে আমাকে স্মরণ করে, তাহলে আমি তাকে আমার মনে স্মরণ করি, সে যদি কোন সভায় আমাকে স্মরণ করে, তাহলে আমি তাকে তাদের চেয়ে উত্তম ব্যক্তিদের (ফিরিশতাদের) সভায় স্মরণ করি। ( সহীহল বুখারী ৭৪০৫)
এক হাদিসে কালবি জিকিরকে জবানের জিকিরের চেয়ে সত্তরগুণ ফযীলতপূর্ণ বলা হয়েছে। জিকির মানে হল স্মরণ করা। আমরা কাউকে কিভাবে স্মরণ করি ? জবানে? না, বরং অন্তরে ।
ইবনে বাত্তাল রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল,
أي الذِّكْرين أعظم ثوابًا
‘কোন জিকির অধিক মর্যাদাবান?’
الذكر الذي هو بالقلب
‘ঐ জিকির যা কলব দ্বারা করে।’
এরপর জিজ্ঞাসা করা হল,
فالذكر الذي باللسان ما هو
তাহলে জবানে জিকির কি ?
তিনি উত্তর দেন, জবানে জিকির মূল জিকির মূল জিকির নয় । বরং তার কলব জিকির করছে তার প্রকাশ ।
আয়েশা রাযি. বলতেন,
لأن أذكرَ الله في نفسي أحبُّ إليَّ من أن أذكُره بلساني سبعين مرَّة
‘আমি জবানে জিকির করি এর চেয়ে সত্তরগুণ প্রিয় হল আমি কলবে জিকির করি।’ (আততাওযিহ, শরহুল বুখারী ৩১/২৫২)
তাবেয়ী আবু উবাইদাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির অন্তর আল্লাহর স্মরণে রত থাকে, ততক্ষণ সে মূলত সালাতের মধ্যেই রয়েছে। যদি এর সাথে তার জিহ্বা ও দুই ঠোঁট নড়াচড়া করে (অর্থাৎ, মনের স্মরণের সাথে সাথে যদি মুখেও উচ্চারণ করে) তাহলে তা হবে খুবই ভালো, বেশি কল্যাণময়। (বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ১/৪৫৩)
হাফেজ্জি হুজুর রহ. বলতেন, জিকির তিন প্রকার। যবানে জিকির, এটা সর্বনিম্ন স্তরের। এর চেয়ে সত্তর গুণ মর্যাদাসম্পন্ন হল, কলবি জিকির। আর সবচেয়ে উত্তম হল কলব এবং জবানের একসাথে জিকির।
দুনিয়াতে যত আল্লাহর অলি আছেন, কেউই সোহবত ছাড়া এবং জিকির ছাড়া আল্লাহর অলি হন নাই ।
অন্তরের জিকিরের কিছু চমৎকার দৃষ্টান্ত
হাত কাজে ব্যস্ত থাকবে কিন্তু কলব আল্লাহর জিকির করবে এটা কিভাবে? আমাদের শায়েখ ও মুরশিদ পীর জুলফিকার আহমেদ নকশবন্দি দা বা এর চমৎকার দৃষ্টান্ত দেন। তিনি বলেন, মা তার সন্তানকে মাদ্রাসায় বা স্কুলে পাঠায়। সারাক্ষণ মনে পড়ে কখন সন্তান বাসায় আসবে। কিন্তু তার ঘরের কাজও চলতে থাকে ।
আরেকটি দৃষ্টান্ত, ড্রাইভার যখন ড্রাইভ করে তখন তার দৃষ্টি থাকে সামনের দিকে। কিন্তু সে পাশের লোকের সাথেও কথা বলে। মোবাইলেও কথা বলে। সামনের দিক থেকে এক মুহুর্তের জন্য দৃষ্টি সরালে এক্সিডেন্ট হতে পারে।
অনুরূপভাবেভ এক মুহুর্তের জন্য আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল থাকলে শয়তান ধোঁকায় ফেলে দিতে পারে। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, বছরের পর বছর আমাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণ থেকে খালি। তাহলে আমরা কি পরিমাণ ধোঁকার মাঝে আছি। এজন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ একটি দোয়া আছে এরকম,
ولا تَكِلْنِي إِلَى نفسي طرفة عَيْنٍ
‘ওগো আল্লাহ! এক পলকের জন্য আমাকে আমার নফসের কাছে সোপর্দ করবেন না।’ কেননা, এক মুহুর্তের গাফলতিতে শয়তান আমাদের দিয়ে একটা কবিরা গুনাহ করিয়ে জাহান্নামি বানিয়ে ফেলতে পারে ।
এই যে ড্রাইভার এর মনোযোগ সামনের দিকে কিন্তু সে পাশের লোকের সাথে কথা বলছে। ঠিক একইভাবে আমাদের মনোযোগ থাকবে আল্লাহর দিকে, সাথে অন্যান্য কাজ ও চলবে। যেমন এই মুহূর্তে আপনারা আমার কথা শুনছেন এটা কিন্তু জিকিরে কলবির জন্য বাধা নয়। আমি বলছি , এটা জিকিরে কলবির পথে বাধা না। আপনারা অন্তরে অন্তরে আল্লাহকে স্মরণ করুন, আমিও করি। দেখি কতক্ষণ ধরে রাখতে পারি। ধরে রাখতে দেয় না নফস, ধরে রাখতে দেয় না ইবলিস। হাদিসের মাঝে এসেছে, ইবলিস আমাদের কলবের দিকে তাকিয়ে থাকে। যখন দেখে অন্তর জিকির থেকে গাফেল হয়ে গেছে তখন সে পাঞ্জা মারে ।
আমাদের কলব তো এমন অবস্থা, তাকানোর দরকার হয় না, যখনই আসে তখনই দেখে সিট খালি। তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে যাদের কলবে আল্লাহর জিকির থাকে।
দাঁড়ি পেকে যাচ্ছে এখনও ঈমানের নূর অনুভব করি নাই
তৃতীয় আরেকটি দৃষ্টান্ত, গ্রামে বেদেরা বড় ঝুপড়িতে তে করে কাঁচের জিনিস বিক্রি করে। মাথায় ঝুপড়ি রেখে দুই হাত ছেড়ে হাঁটতে থাকে। বলেন তো মাথায় এটা কিভবে ধরে রাখে? মাথায় ধরে রাখে মন দিয়ে। এক মুহূর্তের জন্য গাফেল হলে ঝুপড়ি পরে সব জিনিস ভেঙ্গে যেতে পারে। অনুরূপভাবে এক মুহুর্তের জন্যও যদি আল্লাহর স্মরণ থেকে আমাদের অন্তর গাফেল হয়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ইবলিসের কাছে চিৎপটাং।
চিন্তা করে দেখেন আমরা বছরের পর বছর গাফেল। দাঁড়ি পেকে যাচ্ছে এখনো জিকিরের স্বাদ পাই নাই। বুড়ো হয়ে যাচ্ছে এখনও আল্লাহর মারেফাতের নূর অনুভব করে নাই। কবরে চলে যাচ্ছে এখনও নামাজের স্বাদ পাই নাই। এখনও ঈমানের নূর অনুভব করি নাই। তো আল্লাহর বান্দা এটা কেন হচ্ছে? এর কারণ হল, বছরের পর বছর ইবলিস আমাদের উপর আক্রমণ করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। আমাদের মাঝে ঈমানের যত নূর আছে সব ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা তার এই উপর্যুপরি আক্রমণের মোক্ষম জবাব দিচ্ছি না। জিকিরে কালবি ছিল যার মোক্ষম জবাব। সুতরাং আমরা এখন থেকে এটা করতে রাজি আছি তো ইনশাআল্লাহ?
আল্লাহ তাআলা বলেন,
رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ
এমন কিছু লোক আছে, কোনো ব্যবসা বা কেনাবেচা আল্লাহর যিকর থেকে তাদেরকে অমনোযোগী করতে পারে না । (সূরা নূর ৩৭)
অর্থাৎ, কিছু মানুষ এমন আছে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে সে দোকানে বসা, অফিসে বসা, কৃষিকাজে ব্যস্ত কিন্তু তার অন্তর থাকে আল্লাহর জিকির।
ফানাফিল্লাহ কাকে বলে?
এই জিকরে কালবি প্রথম প্রথম আপনি সারাদিনে ১ ঘণ্টাও করতে পারবেন না। বরং আধা ঘণ্টাও পারবেন না। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি, চব্বিশ ঘণ্টার সাড়ে তেইশ ঘণ্টাই যাবে জিকির ছাড়া। হ্যাঁ পারবেন, জিকিরে কলবি করার জন্য যদি আলাদা করে বসেন তখন পারবেন। কিন্তু সব সময় হাত কাজে ব্যস্ত থাকবে আর অন্তরে জিকির থাকবে এটা আপনি আধা ঘণ্টার জন্যও পারবেন না। তাহলে কী করবেন? আপনি শয়তানের সঙ্গে ছিনতাই কর্ম খেলবেন। অর্থাৎ আপনি জিকিরে কালবি শুরু করেছেন কিছুক্ষণ পর শয়তান আপনাকে গাফেল করে দিবে। আবার যখন মনে পড়বে আবার মনে মনে বলা শুরু করবেন ‘আল্লাহ আল্লাহ’। এভাবে যখনই মনে পড়বে তখনই জিকিরে কালবি শুরু করবেন। প্রথম দিন হয়ত ২ মিনিট হবে। দ্বিতীয় দিন ১০ সেকেন্ড হলেও বাড়বে। তৃতীয় দিন হয়ত ৩০ সেকেন্ড বাড়বে। এভাবে একটা সময় আপনি সর্বক্ষণ আল্লাহর ধ্যানে ডুবে থাকতে পারবেন। এটাকেই বলে ফানাফিল্লাহ। এভাবে যদি আল্লাহর মারেফাতের ভিতরে নিজেকে ফানা না করতে পারেন তাহলে ভাল করে মরতেও পারবেন না ।
জিকিরে কালবি করার সহজ রাস্তা
জিকিরে কালবি করার একটা সহজ রাস্তা বলে দেই। প্রতিদিন আপনি ১০- ১৫ মিনিটের জন্য বসবেন। বসে চোখ বন্ধ করে মনে আল্লাহ আল্লাহ বলবেন। এটাকে আমরা মোরাকাবা বলি। এই মোরাকাবা মূল আমল নয়। মূল আমল তো হল জিকরে কালবি। মোরাকাবা হল একটি ট্রেনিং বা প্রাকটিস। আপনি ১৫ মিনিট মোরাকাবা করবেন তাহলে আধা ঘণ্টা জিকরে কালবি করতে পারবেন। আধা ঘণ্টা মোরাকাবা করবেন, ১ ঘণ্টা জিকরে কালবি করতে পারবেন ।
এই দুইটা চিকিৎসা যদি আপনারা গ্রহণ করতে পারেন তাহলে আপনারা ধীরে ধীরে যত বড় আসক্তিই হোক না কেন তা থেকে বের হতে পারবেন । বের হয়ে আল্লাহর মারেফাতের ভিতরে ডুবে যেতে পারবেন ।
এমনও হতে পারে আপনি কোন গুনাহে আসক্ত , এমন সময়ে মৃত্যু এসে পড়েছে । কিন্তু আপনি এই দুইটা আমলে ছিলেন চেষ্টা করেছেন। পড়ে গেছেন আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। ধাক্কা খেয়েছেন আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন । জিকরে কলবি করেন নাই, আবার শুরু করেছেন। কিছুদিন মজলিসে ছিলেন না, আবার হাজির হয়েছেন। এই যে নিয়মিত চেষ্টা করেছেন; এর বরকতে মৃত্যুর আগে হলেও আল্লাহ আপনাকে এমন তাওবা নসিব করবেন যে সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। কারণ আল্লাহর ওয়াদা হল গুনাহ মিটিয়ে দিবেন, নেক আমল দিবেন। এটা কি এক দুইটা মজলিসে বসলে? না , বরং এখানে মজলিসের ফলাফল বলা হয়েছে। মজলিসে বসতে থাকে, বসতে থাকেন তাহলে মৃত্যুর আগে আল্লাহ আপনাকে এমন তাওবা নসিব করবেন সব গুনাহ ধুয়ে যাবে, গুনাহের পরিবর্তে নেক আমল দিয়ে দেয়া হবে।
আসক্তির নগদ কিছু চিকিৎসা
প্রথম চিকিৎসা: নিজেকে নিজে বলবেন ‘আল্লাহকে ভয় কর’
প্রথম, যখন গুনাহ করতে মন চাইবে তখন নিজেকে নিজে বলবেন ‘আল্লাহকে ভয় কর’।
এ বিষয়ে আমরা অনেক হাদিস জানি। বিশেষ করে বুখারির ৩ জনের ঘটনা। গুহাতে আটকা পড়ে গেছে। যার মাঝে একজন এই বলে দোয়া করল, ওগো আল্লাহ, আমার এক চাচাত বোন ছিল। আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। অর্থাৎ, যুবক ছিল এই যুগের যুবকদের মত একই রোগে রোগী !
তো সে দোয়া করতে যেয়ে আল্লাহর কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে বলল যে, আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি তাকে কুপ্রস্তাব দিলাম। কিন্তু সে অস্বীকার করল। একবার সে অভাবে পড়ল। তাই আমার কাছে টাকা চাইতে আসল। আমি তাকে কুকর্মের বিনিময়ে ১২০ দিনার দিতে রাজি হলাম। আমিও অভাবে ছিলাম। কোন রকমে আমি টাকাটা জোগাড় করলাম। যখন আমি খারাপ কাজটা করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েছি। ঠিক তখনি আমার চাচাতো বোন বলে উঠল, আল্লাহকে ভয় কর। ওগো আল্লাহ, তার এই কথার প্রভাবে আপনার ভয়ে আমি সেই কাজ থেকে সরে আসি। আর তার থেকে টাকাটাও আর ফেরত নেই নি। আমার এই কাজটা যদি আপনার জন্য হয়ে থাকে তাহলে পাথরটা একটু খুলে দেন। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা পাথরটা একটু খুলে দিলেন ।
তাহলে বুঝা গেল এটা একটা নগদ চিকিৎসা ।
দ্বিতীয় চিকিৎসা: চোখের খেয়ানত থেকে বাঁচবেন
দ্বিতীয়, চোখের খেয়ানত থেকে বাঁচবেন। বলতে পারেন, নজরের হেফাজত করতে পারি না। আপনি যে পারেন না এটা কি আল্লাহ তাআলা জানতেন না? তাহলে তিনি কেন হুকুম করেছেন? তিনি কি জুলুম করেছেন? নাউযুবিল্লাহ। এর অর্থ হল আমি নজরের হেফাজত করতে চাই না ।
আমাদের বড়রা বলেন, কেউ যদি নিউইয়র্ক শহরে নজরের হেফাজত করতে চায় তাহলে সেটাও সে পারবে। আর যদি কেউ নজরের হেফাজত করতে না চায় তবে হারাম শরিফেও পারবে না। মনে রাখবেন আল্লাহ অসম্ভব কোন কাজের নির্দেশ দেন না।
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। (সূরা বাকারা ২৮৭)
তবে কষ্ট হবে এমন কাজের নির্দেশ দেন। কেননা কষ্টের ভিতরেই আছে জান্নাত। কষ্ট হবে এমন কাজের নির্দেশ দেন কেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
حُجِبتِ النَّارُ بِالشَّهَواتِ، وحُجِبتْ الْجَنَّةُ بَالمكَارِهِ
জাহান্নামকে মনোলোভা জিনিসসমূহ দ্বারা ঘিরে দেওয়া হয়েছে এবং জান্নাতকে ঘিরে দেওয়া হয়েছে কষ্টসাধ্য কর্মসমূহ দ্বারা। (সহীহ বুখারী ৬৪৮৭)
‘ঘিরে দেওয়া হয়েছে’ অর্থাৎ ঐ জিনিস বা কর্ম জাহান্নাম বা জান্নাতের মাঝে পর্দাস্বরূপ, যখনই কেউ তা করবে, তখনই সে পর্দা ছিঁড়ে তাতে প্রবেশ করবে।
জান্নাত দুই কদম
হাসান বসরি রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হল, জান্নাত কয় কদম? তিনি বললেন, জান্নাত দুই কদম। নফসের উপর এক পা দাও। আর দ্বিতীয় কদমে জান্নাত চলে যাও।
কিন্তু নফসের উপর যে পা দিব তার নিচে হয়ত থাকবে জ্বলন্ত কয়লা। এই কয়লার উপর আপনাকে পা টা দিতে হবে। আপনাকে কষ্টটা করতে হবে। কষ্টটা না করলে তো জান্নাত পাচ্ছেন না। আপনার নফসকে জ্বালিয়ে দিতে হবে। আপনার নফসকে দাবিয়ে দিতে হবে। কষ্টটার ভিতরেই যেজান্নাত লুকায়িত!
তাহলে সবাই নজরের হেজাজত করব, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু এর পরেও নজর পড়ে যাবে। নবীজী ﷺ বলেন, নজর পড়ে গেলে দ্বিতীয়টা দিও না তাহলে প্রথমটা মাফ।
বলুন, এর চেয়ে সহজ পদ্ধতি আছে ?
নজর পড়া গুনাহ নয়; নজর দেয়া গুনাহ
হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর কাছে এক লোক চিঠি লিখল, হুজুর কি করব? নজর তো পড়েই যায়। তিনি উত্তর দিলেন, ঠিক আছে ভাই, তবে নজর পড়া গুনাহ নয়। নজর দেয়া গুনাহ। ঐ লোক আবার জিজ্ঞাসা করল, নজর পড়া আর দেয়ার মাঝে পার্থক্য কি? তিনি বললেন, দুই সুরতে নজর দেয়া হয়। নজর পড়ে যাওয়ার পর যদি তুমি তা ধরে রাখ। আর যদি তুমি ইচ্ছাকৃত ভাবে দাও ।
দৃষ্টি হেফাজত করার সহজ পলিসি
অনেক বলে হুজুর কলেজ ভার্সিটিতে পড়ি , সেখানে নজর হেফাজত করতে পারি না। না, আল্লাহর বান্দা ‘পারি না’ বলবেন না, বরং বলেন, ‘করি না’ । নবীজী ﷺ কত সহজ পলিসি আমাদের বলে দিয়েছেন, এই পলিসি ব্যবহার করে যে কোন পরিবেশে আমরা নজরের হেফাজত করতে পারব। গার্লস সকুল বলেন আর ব্যাংক বলেন যেখানেই বলেন ‘নজর পড়া গুনাহ নয়, দেয়া গুনাহ’ এই পলিসি ব্যবহার করে যে কোন জায়গায় নজরের হেফাজত করতে পারবেন। এর পরেও যদি বলেন, আমি পারি না; তবে আমি বলব, আপনি পারতে চান না। যদি বলেন এর পরেও তো পড়ে যায়। তবে আমি বলব, আপনি আপনার দিলকে জিজ্ঞাসা করেন, পড়ে যায় না ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টি দেন? যদি আপনার সুস্থ বিবেক এ কথা বলে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টি দেন না; বরং অনিচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টি পড়ে যায়। তাহলে আপনাকে পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, কবিরা গুনাহ তো দূরের কথা সগীরা গুনাহও হচ্ছে না ।
আর যদি আপনার বিবেক বলে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টি দেন আর আপনি বলছেন যে, অনিচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টি পড়ে যায় তবে আপনি নিজের সাথে ধোঁকাবাজি করছেন।
তৃতীয় চিকিৎসা: ফজরের নামাজের গুরুত্ব দিন
তৃতীয়, ফজরের নামাজের গুরুত্ব দিবেন। যত বড় আসক্তিই হোক; যদি এই নামাজের গুরুত্ব দেন ইনশাআল্লাহ আসক্তি থেকে বের হতে পারবেন। কেননা হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
يَعْقِدُ الشَّيْطَانُ عَلَى قَافِيَةِ رَأْسِ أَحَدِكُمْ إِذَا هُوَ نَامَ ثَلاَثَ عُقَدٍ، يَضْرِبُ كُلَّ عُقْدَةٍ عَلَيْكَ لَيْلٌ طَوِيلٌ فَارْقُدْ، فَإِنِ اسْتَيْقَظَ فَذَكَرَ اللَّهَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، فَإِنْ تَوَضَّأَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، فَإِنْ صَلَّى انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَأَصْبَحَ نَشِيطًا طَيِّبَ النَّفْسِ، وَإِلاَّ أَصْبَحَ خَبِيثَ النَّفْسِ كَسْلاَنَ
তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পিছনের দিকে তিনটি গিঠ দেয়। প্রতি গিঠে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি শুয়ে থাক। তারপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে একটি গিঠ খুলে যায়, পরে অজু করলে আর একটি গিঠ খুলে যায়, এরপর (ফজর) নামাজ আদায় করলে আর একটি গিঠ খুলে যায়। তখন তার সকাল বেলাটা হয়, উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলূষ কালিমা ও আলস্য সহকারে। (সহীহ বুখারী ১১৪২)
যদি ঘুম থেকে উঠে কিছু জিকির করে নেন, অজু করে নেন, আর নামাজ পড়ে নেন তবে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আপনার অন্তর অনেক ফ্রেশ থাকবে। আপনার মনে ভাল ভাল চিন্তা আসবে। আর যদি তা না করেন, তবে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আপনার অন্তর টা হবে খবিস অন্তর। সারাদিন গুনাহের চিন্তায় মাথা কিলবিল করবে।
চতুর্থ চিকিৎসা: বিয়ে করে নেয়া
চতুর্থ, কেউ যদি যৌনতার সাথে সম্পৃক্ত গুনাহে প্রবল আসক্ত হয় তবে তাকে বিয়ে করতে হবে। বিয়ে না করলে গুনাহ থেকে কিছুদিন হয়ত বেঁচে থাকতে পারবে কিন্তু কিছুদিন পর আবার গুনাহে জড়িয়ে পড়বে। বিয়ে না করে রোজা রেখে, জিকির করে, নেক মজলিসে বসে কিছুদিন ঠিক থাকতে পারবে। কিন্তু পুরা বের হতে পারবে না। পুরা বের হতে হলে বিয়ে করতে হবে। এজন্যই আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে বলেছেন,
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ؛ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ
হে যুব সম্প্রদায়! যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে, সে যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা বিয়ে চোখকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে সংযত করে। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোজা পালন করে। রোজা তার প্রবৃত্তিকে দমন করে। ( সহীহ বুখারী ১৯০৫)
স্ত্রীকে সময় দিন
কেউ বলতে পারেন, বিয়ে করার পরেও তো আমি গুনাহে অভ্যস্ত। এর অর্থ হল, মূলত সে স্ত্রীকে সময় দেয় না। তার সময় যায় ফেসবুকে, ইউটিউবে, গুগলে। কোন ব্যক্তি ঔষধ এনে শোকেসে রেখে দিয়েছে। কোন কাজ হবে? স্ত্রী হল যৌনতার সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় গুনাহের ঔষধ। স্বামীর জন্য স্ত্রী আর স্ত্রীর জন্য স্বামী। হাদিসে আছে স্বামী যখন স্ত্রীকে আহবান করে আর স্ত্রী যদি সাড়া না দেয় তবে ফেরেশতারা তাকে লানত করে। বলতে পারেন, পুরুষদের বেলায় এ ধমকি নাই কেন? কারণ আগ্রহ সৃষ্টি না হলে পুরুষদের সামর্থ্য থাকে না কিন্তু স্ত্রীদের থাকে। তাই পুরুষদের বলা হয়েছে, স্ত্রীদের সাথে রোমান্টিক কথা বলো। মেয়েদের যৌন চাহিদা কম কিন্তু অন্তরের চাহিদা বেশি। আর পুরুষদের যৌন চাহিদা বেশি কিন্তু অন্তরের চাহিদা কম। আপনি স্ত্রীকে একটু ঘুরতে নিয়ে যান, দুই একটা প্রেমময় কথা বলেন, এখন আপনি তাকে দিয়ে যা ইচ্ছা কর্মাতে পারবেন। পুরুষরা যেরকম কঠিন কথা, রুক্ষ কথা সহ্য করতে পারে, স্ত্রীরা সেটা পারে না। এভাবে উভয়ে যদি আপন দায়িত্ব পালন করে তাহলে পুরুষ যৌনতার সাথে সম্পৃক্ত গুনাহে আসক্ত হবে না, স্ত্রী পরকিয়াতে আসক্ত হবে না। অধিকাংশ মেয়ে পরকীয়া করে স্বামীর কাছে আদর না পাওয়ার কারণে, অধিকাংশ স্বামী যৌনতার সাথে গুনাহে লিপ্ত থাকে স্ত্রী থেকে আকাঙ্ক্ষা পুরা না হওয়ার কারণে।
ছেলে মেয়ে উপযুক্ত হলে তাদের বিয়ে না করানো অপরাধ
বলতে পারেন, বিয়ে তো করতে চাই কিন্তু বাবা মা তো বিয়ে করায় না। মনে রাখবেন, ছেলে মেয়ে উপযুক্ত হলে তাদের বিয়ে না করানো অপরাধ। যদি বাবা মা বিয়ে না করায় তাহলে সন্তান যত গুনাহ করবে তার সব বাবা মায়ের কাঁধেও আসবে ।
এবার যুবকদের বলি, বাবা মা বিয়ে করায় না এজন্য গোপনে গোপনে প্রেম করেন। প্রেম করেন কেন? গোপনে গোপনে বিয়ে করতে পারেন না? প্রেম হারাম। প্রেম করলে নিজের ইজ্জত যায়। বাবা মায়ের ইজ্জত যায় গোপনে গোপনে যদি বিয়ে করে নেন তবে তা কি হারাম? হারাম না। বলতে পারেন, তাহলে কি বাবা মায়ের নাফরমানি করব? বাবা মায়ের নাফরমানির গুনাহ আপন জায়গাতে। এজন্য সমন্বয় করবেন, বাবা মাকে বলবেন বিয়ে করিয়ে দেওয়ার জন্য। বলতে পারেন, যে শরম লাগে। দিনের পর দিন একটা গুনাহে লিপ্ত থাকার চেয়ে এ শরমটা বড় হয়ে গেল! যদি বাবা মাকে বলতে না পারেন চাচা মামা যাকে পারেন তাকে দিয়ে বলাবেন। যদিও কোনভাবেই না পারেন তাহলে গোপনে গোপনে বিয়ে করে নেন তবুও গুনাহ থেকে বের হয়ে আসেন। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।
আরো পড়ুন: পর্ব ০১: আসক্তি বা addiction: যে রোগে আমরা সকলেই রোগী
আরো পড়ুন: পর্ব ০২: পর্ণগ্রাফি, নেশা ইত্যাদিতে আসক্ত হওয়ার কারণসমূহ