পর্ণগ্রাফি, নেশা ইত্যাদিতে আসক্ত হওয়ার কারণসমূহ

যে ব্যক্তি বদঅভ্যাসের বেড়াজাল থেকে বের হতে চায়, তার প্রতি নসিহত

আসক্তি (addiction)

(পর্ব ০২)

শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

আসক্তির প্রথম কারণ: ঈমানি দুর্বলতা

এখন প্রশ্ন হল, মানুষ বিভিন্ন গুনাহে এডিক্টেড কেন হয়? কেন সে পর্ণগ্রাফি নেশা কিংবা অন্যান্য গুনাহতে আসক্ত হয়? কেন হয়–এটা যদি আমরা বের করতে পারি তাহলে এর চিকিৎসাটাও আমরা সহজেই বের করতে পারবো।

এর মৌলিক কারণ হলো ৬ টা। ১. ঈমানি দুর্বলতা। ঈমানি দুর্বলতার কারণে সে বিভিন্ন গুনাহে আসক্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন বাজে অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ে।

ঈমানি দূর্বলতার তিন আলামত

১. সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও গুনাহ না ছাড়া

আর একজন মানুষের ঈমান যে দুর্বল তার তিনটি আলামাত আছে।

প্রথম আলামত হল, যে গুনাহটি সে ছেড়ে দেয়ার সামর্থ্য রাখে সে গুনাহটি সে ছাড়বে না। যেমন, সে পারে রাত ১০ টা বাজে ওয়াইফাইটা অফ করে, মোবাইল সুইচ অফ করে ঘুমিয়ে পড়বে, বিছানা ধরবে। এরপর দোয়া-দুরুদ পড়লে তার ঘুম চলে আসবে। এটা তার দ্বারা সম্ভব। অসম্ভব না। কিন্তু সে এটা করবে না। বরং সে অপেক্ষায় থাকবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার, সে অপেক্ষায় থাকবে স্মার্টফোনটা হাতে নেওয়ার। রাত ১২ টা অথবা ১ টায় প্রথমে ফেসবুক চালাবে বা অন্যগুলো চালাবে। এরপর যত রাত গভীর হবে তত সে অশ্লীলতার গভীরে ডুবতে থাকবে। কারণ, এটা থেকে সে বের হতে চায় না। অথচ সে কিন্তু ইচ্ছা করলে এ থেকে বের হয়ে আসতে পারে।

একজন লোক পারে যে, সে রাস্তায় অবনত হয়ে চলবে, পরনারীর প্রতি সে দৃষ্টি দিব না। এটা সে পারে। কিন্তু মনের ইটিশপিটিশের কারণে পারে না।

একজন লোক সুদের কারবার করে। বলুন তো সে যদি সুদের কারবারটা বন্ধ করে দেয় তাহলে কি সে মারা যাবে? না খেয়ে মারা যাবে? তার জীবনে কি দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে? তাহলে সুদের কারবারটা কেন সে ছাড়ে না? কারণ, সে ছাড়বে না। তার সিদ্ধান্ত হলো, সে ছাড়বে না। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সে এখান থেকে ফিরে আসবে না। এই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও গুনাহ থেকে ফিরে না আসা–এটাই আলামত হল তার ঈমান প্রচন্ড রকম দুর্বল।

এভাবে যে যে গুনাহ দ্বারা এডিক্টেট ইচ্ছা করলে সে ওই গুনাহ থেকে বের হতে পারে। এরপরেও সে তার শক্তি ও সামর্থ্যটাকে কাজে লাগায় না। কেন? কারণ হলো কাজে লাগানোর জন্য তাকে যে শক্তি দিবে, পিছন থেকে যে তাকে ঠেলবে সেই ঈমানি শক্তিটা তার কাছে নাই। ঈমানি শক্তির বড়ই অভাব!

২. নেক আমল  ভালো না লাগা

ঈমানি দুর্বলতার দ্বিতীয় আলামত হল, তার নফস নেক আমলের প্রতি আগ্রহী হবে না। বলুন তো, একজন রোগীর কাছে ভালো খাবার কি সুস্বাদু মনে হয়? যদি সে জ্বরাক্রান্ত হয় তাহলে তার কাছে সুস্বাদু খাবারও কী মনে হয়? তিতা মনে হয়। অনুরূপভাবে এ ব্যক্তিও রুগী। কেননা, সেতো এডিক্টেড। যার ফলে তার কাছে নেক আমল ভালো লাগবে না। নেক পরিবেশ তার কাছে ভালো লাগবে না। বরং তার কাছে এসবই গায়ের  কাঁটা মনে হবে। নেক পরিবেশের কথা শুনলেই তার চুলকানি শুরু হবে। নেক আমলের কথা শুনলেই তার হাঁসফাঁস শুরু হবে। তার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। কুকুরের পেটেতো আর ঘি হজম হয় না! এদের চরিত্রও হয়ে গেছে এখন কুকুরের মত। ফলে নেক পরিবেশ কিংবা নেক আমলের মতো ঘি এখন আর এদের পেটে হজম হয় না। আল্লাহ বলেন,

إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيلًا

তারা কেবল পশুদের মতো; বরং তারা আরো অধিক পথভ্রষ্ট। (সূরা ফুরকান ৪৪)

৩. হারাম উপার্জনে ব্যস্ত থাকা 

ঈমানি দুর্বলতার তৃতীয় আলামত হল, হকদারের কাছে আমানত সে পৌছে দিবে না। মানে কি? অর্থাৎ সে হারাম উপায়ে উপার্জনের ভিতরে ব্যস্ত থাকবে। হারাম ইনকামের মধ্যে সে ব্যস্ত থাকবে। এটাও ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ার অন্যতম আলামত।

তাহলে একজন লোক কোনো একটি গুনাহে আসক্ত হয়ে পড়ার প্রধান কারণ কী? ঈমানি দুর্বলতা। দুর্বল ঈমানের কারণে গুনাহর নেশা তাকে পেয়ে বসে।

আসক্তির দ্বিতীয় কারণ: অসৎ সঙ্গ

আসক্তির দ্বিতীয় কারণ হল, অসৎ সঙ্গ। অসৎ সঙ্গ বুঝেন কি? স্বামী ভালো বউটা খারাপ। কয়দিন পরে স্বামীটাও নষ্ট হয়ে যায়। স্ত্রী ভালো স্বামী খারাপ। কয়দিন পর স্ত্রীও আর জায়গা মতো থাকে না। হয়তো বাবার বাড়িতে তাহাজ্জুদ পড়তো। এখন স্বামীর সংসারে এসেছে। কিছুদিন একসাথে ছিল এখন দু’টাই নষ্ট হয়ে গেছে। এটাকেই বলে অসৎ সঙ্গ। অনুরূপভাবে অনেকে বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে গুনাহয় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। নোংরা চরিত্র ও বাজে অভ্যাসে আসক্ত হয়ে পড়ে।

বন্ধু কবরেও গিয়ে পর্ণগ্রাফি পাঠায়

একটা ঘটনা মনে পড়ল। আরব বিশ্বের অন্যতম আলেম ড. মুহাম্মাদ আল আরিফি। তাঁর একটা বয়ানে শুনেছি। তিনি বলেন, এক যুবক তাঁর কাছে খুব লজ্জিত হয়ে আসলো এবং কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। শায়েখকে সে জানালো, শায়েখ! আমি খুব বিপদে আছি। আমার বন্ধু মারা গেছে। আমার বন্ধু কবরে চলে গেছে। সে তো কবরে চলে গেছে কিন্তু তার ইমেইল আইডি থেকে আমার ইমেইলে এখনো প্রতিনিয়ত পর্ণ মুভি আসে। বন্ধুতো কবরে চলে গেছে কিন্তু আমার কাছে পর্ণ মুভি পাঠানো বন্ধ হয় নাই। এইজন্য আমি খুব টেনশনে আছি।

শায়েখ বললেন, খুলে বল কী ঘটনা?

যুবক বলা শুরু করল, আমরা কয়েকজন বন্ধু ছিলাম। সবাই এক সময় নামাজ-কালাম পড়তাম। ভালো ছিলাম। কিন্তু কোথা থেকে আমাদের সাথে একজন খারাপ বন্ধু জুটে গেলো টের পাই নাই। সে বিভিন্ন সময় আমাদেরকে স্মার্টফোনে বিভিন্ন জিনিস দেখাতো। বন্ধুবান্ধব অকৃত্তিম সম্পর্কের হয়। তখন আমরাও বন্ধুর পাল্লায় পড়ে মাঝে মাঝে এগুলো দেখা শুরু করে দিলাম। একটা সময় সে আর সাধারণ জিনিস দেখায় না। আমাদেরকে একেবারেই খারাপ অশ্লীল মুভিগুলো দেখানো শুরু করল। সরাসরি ব্যভিচার টাইপের জিনিসগুলো দেখানো শুরু করল। প্রথম প্রথম আমরা তাকে বকাঝকা করতাম। কিছু ওয়াজ নসিহতও করতাম, কিছু উপদেশও দিতাম। বলতাম, এগুলো ভালো না ভাই, ঠিক হয়ে যাও। কিন্তু মনে মনে আবার চাইতাম যে, একটুখানি আরো দেখি। একদিন দুইদিন এরকম হতে হতে একটা পর্যায়ে এসে আমরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একটা সময়ে সব বন্ধুবান্ধব মিলে একেবারে গ্রুপিংভাবে এই নোংরা জিনিসগুলো দেখা শুরু করলাম।  তো একদিন আমাদের ওই বন্ধুকে বললাম, বন্ধু! তুমি দেখি প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস আনো, ঘটনা কী! কোথায় পাও এগুলো!?  আমরা ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে তো এগুলো পাই না। তো বন্ধু আমাদেরকে বলল, আমি একটা ওয়েবসাইটের সাবস্ক্রাইবার। যখনই কোন নতুন ভিডিও আপলোড হয় আমার কাছে নোটিফিকেশন আসে আর আমি সেটা পেয়ে যাই। আমরা আগ্রহ প্রকাশ করলাম এবং বললাম, আমাদেরকেও ওটার সাবস্ক্রাইবার বানিয়ে দাও। সে উত্তর দিল, ডলার খরচ হবে। এরপরেই বন্ধু আমাদেরকে যুক্তি দিলো, ডলার খরচের দরকার নাই। তোমরা নিজেদের মেইল আইডি আমার কাছে দিয়ে দাও। আমি এমন একটা সিস্টেম করে দিবো যে, যখন আমার কাছে নতুন ভিডিওর নোটিফিকেশন আসবে তখন তোমাদের কাছেও অটোমেটিক নোটিফিকেশন চলে যাবে, ফরওয়ার্ড করে দিবো আমি। তোমরা আমার মতো দেখতে পারবা। আল্লাহর কী হুকুম! এরপরে হল কী! আমাদের ওই বন্ধু হঠাৎ করে এক্সিডেন্টে মারা গেলো। একেবারে বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে অন দ্যা স্পট মারা গেলো। বন্ধুতো কবরে চলে গেল কিন্তু সে কী করে গেছে জানি না; হয়ত কোন অটো সিস্টেম করে গেছে যে, তার আইডি থেকে নটিফিকেশন আসা এখনও বন্ধ হয় নাই। এখনও ওই ওয়েবসাইটে যখনই কোনো ভিডিও আপলোড হয় সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আইডিতে নোটিফিকেশন চলে আসে। এভাবে আমাদের বন্ধু এখনও কবর থেকেও আমাদের কাছে পর্ণ মুভির নোটিফিকেশন পাঠাচ্ছে! আমার তো ভয় হয়, এর কারণে আমার কী হয়! তাই আমি তওবা করতে এসেছি।

শায়েখ আরেফি বললেন, ব্যাপারটাতো কঠিন কিছু নয়। ওয়েবসাইট কতৃপক্ষের কাছে তোমরা মেইল করে বল, আমরা আর এটা চাই না। এটা পাঠানো বন্ধ করে দাও।

তখন যুবক বলল, এই চেষ্টাও আমরা করেছি। কিন্তু কতৃপক্ষ আমাদেরকে জানালো, তোমার আইডি দিয়ে আমাদের ওয়েবসাইটে কোন সাবস্ক্রাইবার নাই। কাজেই আমরা এটা অফ করতে পারবো না। যার আইডি তার মেইল থেকে যদি আমাদের অফ করার জন্য বলা হয় তাহলে আমরা অফ করবো। এর আগে নয়। এখন সমস্যা হল, আমাদের ওই বন্ধুর আইডির পাসওয়ার্ড তো আমাদের জানা নাই। পাসওয়ার্ড আমরা উদ্ধার করার চেষ্টাও করেছি, কিন্তু হয় নাই। যার কারণে বন্ধুর কাছে যতবার নোটিফিকেশন আসে আমাদের কাছেও ততবার নোটিফিকেশন আসে।

চিন্তা করে দেখুন,  এই যে এতগুলো বন্ধু পর্ণমুভিতে এডিক্টেড হল কার কারণে? একটা খারাপ বন্ধুর কারণে। আসলে একটি সুন্দর পরিবেশকে নষ্ট করার জন্য একজন এডিক্টেডই যথেষ্ট। একজন আসক্ত রোগীই যথেষ্ট। আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তাওফিক দান করুন (আমিন)।

খারাপ বন্ধু বিশাক্ত সাপের চাইতেও খারাপ

ফারসিতে একটা প্রবাদ আছে, یارِ بد بدتر بود از مار بد  অর্থাৎ খারাপ বন্ধু বিশাক্ত সাপের চাইতেও খারাপ। কিছু বন্ধু থাকে, যারা সব সময় অন্যদের নিয়ে সমালোচনা বা পরচর্চা করতে পছন্দ করে। অন্যদের নিয়ে মিথ্যা/বানোয়াট গল্প সাজাতেও তাদের জুড়ি নেই। বিভিন্ন গুনাহর কাজটিও তারা ভালোভাবে করতে জানে। এদের কাছ থেকে দূরে থাকুন। নবীজী ﷺ এদের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বলেন, এরা কামারের হাপরের মত। وإمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيحًا مُنْتِنَةً হয় তোমার বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে, নচেৎ তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে আর না হলে অন্তত দুর্গন্ধ হলেও পাবে। (সহিহ বুখারী ২১০১)

এমন বন্ধু নির্বাচন করুন, যে আপনাকে না পেলে জান্নাতে খুঁজবে

বিপরীতে ভালো বন্ধু হলে কী হয় দেখুন,  হজরত হাসান বসরি রহ. লিখেন যে, এক লোক জাহান্নামি হয়ে যাবে। সে জাহান্নামে চলে যাবে। যার এক বন্ধু ছিল ভালো, যে জান্নাতে যাবে। জান্নাতি বন্ধু পৃথিবীতে থাকাকালীন সময়কার স্মৃতিচারণ করবে। তখন তার বন্ধুর কথা মনে পড়ে যাবে। তাই সে ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করবে, مَا فَعَلَ صَدِيقِي فُلانٌ؟ وَصَدِيقُهُ فِي الْجَحِيمِ ‘আমি তো আমার সেই বন্ধুকে জান্নাতে দেখছি না, সে কোথায়?’ বলা হবে, ‘সে তো জাহান্নামে’। তখন সেই জান্নাতি বন্ধু আল্লাহর কাছে বলবে, ‘হে আমার রব! আমার বন্ধুকে খুব মিস করছি। তাকে ছাড়া আমার কাছে জান্নাতের আনন্দ যে পরিপূর্ণ হচ্ছে না!’

এবার বলুন, জান্নাতিদের কোন আশা অপূর্ণ থাকবে এমনটি কি হবে? বরং আল্লাহ তাআলা তো বলেছেন,

وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِىٓ أَنفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ

সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্যে আছে তোমরা দাবী কর। (সূরা ফসসিলাত ৩১)

আল্লাহ জান্নাতিদের সকল আশা পূরণ করবেন। কেবল মনে মনে চিন্তা করবে সাথে সাথে পূরণ হয়ে যাবে। তাই আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বলবেন, ‘হায়, আমার জান্নাতি বান্দার ইজ্জত যায়! তাড়াতাড়ি ওই জাহান্নামি বন্ধুটাকে জাহান্নাম থেকে বের কর।’

দেখুন, তার বন্ধু জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেল এই কারণে নয় যে, সে রাতভর ইবাদত করত কিংবা কুরআন পড়ত, বেশি বেশি সাদাকাহ করত, দিনের পর দিন রোজা রাখত! বরং সে মুক্তি পেল কেবলই এই কারণে যে তার বন্ধু তাকে স্মরণ করেছে। তার জান্নাতি বন্ধুর সম্মানের খাতিরে তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।

এই অবাককরা দৃশ্য দেখে জাহান্নামের বাকি লোকগুলো জানতে চাইবে, ‘কী কারণে তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হল, তার বাবা কি শহিদ? তার ভাই কি শহিদ? তার জন্য কি কোন ফেরেশতা বা নবী সুপারিশ করেছেন?’

জাহান্নামিরা এজাতীয় বহু প্রশ্ন ও মন্তব্য করতে থাকবে। কেননা, বিষয়টা তখন জাহান্নামের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যাবে যে, কোনো সুপারিশ ছাড়া জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে!

তখন তাদের এসব প্রশ্নের জবাবে বলা হবে, ‘না, বরং দুনিয়াতে তার যে নেককার বন্ধু ছিল, সেই বন্ধু জান্নাতে তার কথা স্মরণ করেছে। তার কথা জিজ্ঞেস করেছে। তাই আল্লাহ তাআলা তার জান্নাতি বান্দার আশা পূর্ণ করার জন্য এই জাহান্নামিটাকে জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন।’

এই কথা শুনে জাহান্নামিরা আফসোস করে বলবে, ‘হায়! আজ আমাদের জন্য কোন সুপারিশকারী নেই হায়! আমাদের এমন কোনো সত্যিকারের বন্ধু নেই!’ (তাফসিরে বগভি ৩৭১)

উক্ত ঘটনা বর্ণনা করার পর হাসান বসরি রহ. বলেন, এই কারণেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন যে, সেদিন জাহান্নামিরা বলবে,

فَمَا لَنَا مِنْ شَافِعِينَ  وَلا صَدِيقٍ حَمِيمٍ

আজ আমাদের না আছে কোনো সুপারিশকারী এবং না আছে কোনো সুহৃদয় বন্ধু। (সূরা আশ-শুআ’রা ১০০, ১০১)

যার তার সঙ্গে মুহব্বতের সম্পর্ক নয়

একারণেই যেখানে সেখানে আত্নীয়তা নয়। যার তার সঙ্গে বন্ধুত্ব নয়। যার তার সঙ্গে মুহব্বতের সম্পর্ক নয়। আপনি আজ আপনার যে নেতার পিছনে স্লোগান দিচ্ছেন, তার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কিন্তু লেনদেনের। স্লোগান বন্ধ করবেন, ডাস্টবিনে ফেলে দিবে। স্লোগান বন্ধ করে দেন, রাস্তার কিনারায় ফেলে দিবে। মামলা ঠুকে দিবে। জেলে ঢুকিয়ে দিবে। আর একজন ভালো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন, তাঁকে ভালবাসবেন আল্লাহর বান্দা জান্নাতে গিয়েও আপনার কথা স্মরণ করবে। তার উসিলায় আপনি জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে যাবেন।

এই দিল সাধারণ কোনো বিষয় নয়

যাকে তাকে দিল দিবেন না।  এই দিল সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এই দিল অনেক বড় বিষয়। আপনি এক কোটি টাকা কাউকে দিয়ে দিতে পারেন। আপনার গাড়ি বাড়ি কাউকে দিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এই দিল দিতে হবে একমাত্র আল্লাহর মুহাব্বতের ভিত্তিতে। কারণ এক কোটি টাকা লস, দুনিয়ার সাময়িক লস। কিন্তু এই দিল যদি কোন নাপাক লোককে দিয়ে দেন, কোন ফাসেক-ফুজ্জারকে দেন তাহলে এই লোকটাই আপনাকে জাহান্নামে নিয়ে ছাড়বে। পক্ষান্তরে কোন ভালো লোককে যদি দেন তাহলে হয়ত আমল খুব করতে পারেন নাই। কিন্তু কোন নেককারকে আপনি মুহাব্বত করেছেন, কোন নেককারের সাথে আপনি চলাফেরা করার চেষ্টা করেছেন। আর আপনি লজ্জিত ছিলেন আপনার গুনাহ নিয়ে। তাহলে ‘ইনশা-আল্লাহ’ কিয়ামতের দিন বলতে পারবেন,

أُحِبُّ الصَّـالِحِينَ وَلَسْتُ منهم

لعلِّي أَنْ أَنَالَ بِهمْ شَفَاعَــــة

لعل الله يرزقني صلاحا

‘ওগো আল্লাহ! নেককার হতে পারি নাই, কিন্তু তাদেরকে ভালো তো বেসেছি। এই আশায়, যেন তাদের সুপারিশ পেয়ে যাই।’ আর আপনার হাবিব ﷺ তো বলেছেন, المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ ‘যার সাথে যার মুহাব্বত তার সাথে তার হাশর।’ (বুখারী ৬১৬৯) ওগো আল্লাহ! ভালো তো হতে পারি নাই, কিন্তু ভালো লোককে তো ভালোবেসেছি, এই আশায়, যেন আপনি আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।’

অন্তরের লেনদেন কতটা গুরুত্বপূর্ণ হলে নবিজি ﷺ আমাদেরকে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন যে, এভাবে দোয়া করবে,

 اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ حُبَّكَ وَحُبَّ مَنْ يُحِبُّكَ ، وَحُبَّ عَمَلٍ يُقَرِّبُ إِلَى حُبِّكَ

হে আল্লাহ! আমি চাই আপনার প্রতি ভালবাসা। আপনাকে যারা ভালবাসেন তাদের ভালবাসা এবং যে সব আমল আমাকে আপনার নিকট করবে সেসব আমলের ভালবাসা। (তিরমিজি ৩২৩৫)

যাই হোক, তো মানুষ বিভিন্ন গুনাহে এডিক্টেড হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে , বন্ধুত্ব বা সঙ্গদোষ। আর প্রথম কারণ হিসেবে বলেছিলাম, ঈমানি দুর্বলতা। ঈমান দুর্বল হওয়ার কারণে মানুষ বিভিন্ন গুনাহে আসক্ত হয়ে পড়ে।

আসক্তির তৃতীয় কারণ: দৃষ্টির হেফাজত না করা

আসক্তির তৃতীয় কারণ হল, দৃষ্টির হেফাজত না করা। যত ধরণের আসক্তি আছে, যেমন সম্পদের প্রতি আসক্তি, মাদকাসক্তি, পর্ণগ্রাফির প্রতি আসক্তি, গেমসের প্রতি আসক্তি, মাদকাসক্তি ইত্যাদি দৃষ্টির হেফাজত না করার কারণেও হতে পারে।

অন্যের সম্পদের প্রতি তাকিয়েছেন বিধায় আপনার অন্তরে হারাম মালের প্রতি আসক্তি জমাট বেঁধেছে। কারণ, তখন চিন্তা করেছেন, আমাকেও তার মতো হতে হবে। আমাকেও গাড়ি হাঁকাতে হবে, বাড়ি বানাতে হবে, সম্পদের পাহাড় গড়তে হবে।

পরনারীর প্রতি, পরনারীর ফটো কিংবা ভিডিওর প্রতি কুদৃষ্টি দিয়েছেন বিধায় পর্ণগ্রাফির প্রতি আসক্তি সৃষ্টি হয়েছে। মাস্টারবেশন বা হস্তমৈথুনের রোগ চলে এসেছে।

সুতরাং বুঝা গেল, বিভিন্ন আসক্তির অন্যতম কারণহল, এই চোখ। এইজন্য আল্লাহ তাআলা বলেছেন যে, মনে রাখবে,

إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا

নিশ্চয় কান, চোখ আর অন্তর- এগুলোর সকল বিষয়ে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (সূরা ইসরা ৩৬)

আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে বলেছেন,

يَعْلَمُ خَآئِنَةَ ٱلْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِى ٱلصُّدُورُ

আল্লাহ চক্ষুর অন্যায় কর্ম সম্পর্কেও অবগত, আর অন্তর যা গোপন করে সে সম্পর্কেও। (সূরা গাফির ১৯)

এইজন্য নবিজি ﷺ বলেছেন,

زِنَا العَيْنِ النَّظَرُ

চোখের ব্যভিচার হল দৃষ্টি দেওয়া। (সহিহ বুখারী ৬২৪৩)

এইজন্য আল্লাহ তাআলা কুরআন মজিদে মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন,

 قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ

মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযাত করে। এতে তাদের জন্য উত্তম পবিত্রতা রয়েছে; তারা যা করে সেই বিষয়ে আল্লাহ অবহিত। (সূরা নূর ৩০)

উম্মতের প্রতি নবীজির উইশ

দৃষ্টি যদি আপনি অবনত রাখেন তাহলে আমি আপনাকে বলবো যে, যতগুলো গুনাহ আপনার জিন্দেগীতে আছে, চাই সেটা সম্পদের সাথে সম্পর্কিত হোক অথবা যৌনতার সাথে সম্পর্কিত হোক অথবা পেটের সাথে সম্পৃক্ত হোক; মোটকথা, যেটার সাথেই সম্পৃক্ত হোক না কেন; সবগুলো গুনাহকে যদি আপনি ভাগ করেন, মনে করুন, একলক্ষ গুনাহকে যদি আপনি ভাগ করেন তাহলে কমপক্ষে ৯০ হাজার গুনাহ ‘নাই’ হয়ে যাবে শুধু এই চোখের হেফাজতের কারণে। এই কারণেই হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. বলতেন, ‘চোখের হেফাজতের চেয়ে বড় কোন নফল আমল নাই। এই যে তুমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য কুদৃষ্টি না দিয়ে চোখটাকে নামিয়ে নিয়েছ, এটা আমার দৃষ্টিতে লক্ষ লক্ষ রাকাত নফল নামাজের চাইতেও উত্তম।’ কেননা, এই লক্ষ রাকাত নফল নামাজ তোমাকে জান্নাতে নিতে পারবে কি না–এই নিশ্চয়তা নাই। কিন্তু তোমার এই চোখের হেফাজত তথা যৌবনের হেফাজতের কারণে তোমাকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার জিম্মাদারি নিয়ে নিয়েছেন স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ। তিনি বলেছেন,

مَن يَضْمَن لي ما بيْنَ لَحْيَيْهِ وما بيْنَ رِجْلَيْهِ، أضْمَنْ له الجَنَّةَ

কে আছে এমন যে তার দু’চোয়ালের মাঝের বস্তু জিহ্বা এবং দু’রানের মাঝখানের বস্তু লজ্জাস্থানের জামানত আমাকে দিবে? তাহলে আমি তার জান্নাতের যিম্মাদার হব। (বুখারী ৬৪৭৪)

দেখুন, উক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায়, জবান ও যৌবনের হেফাজত করা; এটা উম্মতের প্রতি নবীজির বিশেষ উইশ বা আকাঙ্ক্ষা। নবীজির এই উইশ পূরণ করা উম্মত হিসেবে আমাদের কর্তব্য এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের একটি শক্তিশালী মাধ্যমও। যদি তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা আমরা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি তাহলে প্রতিদান হিসেবে তিনি আমাদের জন্য জান্নাতের জিম্মাদারি নিয়ে নিবেন।

আসক্তির চতুর্থ কারণ: বেকারত্ব

আসক্তির চতুর্থ কারণ হল, বেকারত্ব। কাজ নাই এইজন্য পাবজি খেলে। কাম-কাজ নাই এইজন্য বসে বসে মুভি দেখে।  কোন কাম-কাজ নাই এইজন্য বসে বসে আড্ডা দেয়, বন্ধুবান্ধবের সাথে ইয়াবা খায়, গাঁজা খায়। কাম কাজ নাই এইজন্য স্কুলের সামনে বসে বসে…।

একবার একযুবক এসে আমাকে তার তাওবার জিন্দেগির আগের কাহিনী শুনাচ্ছিলো যে, শায়েখ! একটা সময় ছিল কলেজে গেলে নাম্বার দিতাম। এই মেয়ের নাম্বার এত। ওই মেয়ের নাম্বার এত। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই! কিসের নাম্বার দিতা? সে উত্তর দিল, শায়েখ! কীভাবে যে বুঝাবো; বুঝে নেন না!

তো কারা করে এইগুলা? যাদের কোন কাম-কাজ নাই তারাই এজাতীয় ফালতু কাজ বেশি করে। সুতরাং বুঝা গেল, বেকারত্ব একটা সমস্যা। বরং বহু গুনাহর জ্জমদাতা হল, বেকারত্ব। এজন্যই আরবিতে একটা প্রবাদ আছে, رأس الكسلان بيت الشيطان অলস মস্তিস্ক শয়তানের ঘর, শয়তানের বসবাসের অ্যাপার্টমেন্ট।

আল্লাহর ওলিদের মাঝে আর আমাদের মাঝে পার্থক্য 

ব্যস্ত মানুষ গুনাহ করার সুযোগ পায় কম। এই যে আল্লাহর ওলিরা বলুন তাদের কি গুনাহ করতে মনে চায় না? তারা কি মানুষ না? তাদের কি মনে চায় না পরনারীর প্রতি একটু দৃষ্টি দেই? অমুক গুনাহটা করে একটু মজা নেই?  চায়। তাদেরও মন কখনও কখনও গুনাহ করার জন্য নড়েচড়ে উঠে। গুনাহ করতে মনে চায় না জগতে এমন কেউ নাই। যুগের আব্দুল কাদির জিলানি হলেও তারও গুনাহ করতে মনে চায়। তাহলে আল্লাহর ওলিদের মধ্যে আর আমাদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? পার্থক্য হল, আল্লাহর ওলিরা দীনের কাজে এমন ব্যস্ত থাকেন এবং এমন ব্যস্ত থাকেন যে, গুনাহের চিন্তা তাদের মাথায় সহজে আসে না। আসলেও ব্যস্ততার কারণে সুযোগ পান না। পরিবেশ পান না। কদাচিৎ সুযোগ কিংবা পরিবেশ পেলেও শরীরে এনার্জি থাকে না। সারাদিন দীনের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, গুনাহ করার মত এনার্জি কিভাবে থাকবে!?

আল্লাহর ওলিরা নফসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন

যেমন ধরুন, পরনারীর প্রতি দৃষ্টিটা দিতে মনে চাইল। আমরা কী করি; নফসের আশাটা সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করে দেই। আর আল্লাহর ওলিরা কী করেন? নফসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ফলে আমরা গুনাহ ছাড়ার পরিবেশ পাই না আর তাঁরা গুনাহ করার পরিবেশ পান না। কেননা, মুজাহাদা তথা নফসের সঙ্গে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার কারণে আল্লাহ তাআলা তাঁদের চারিপাশের পরিবেশটাকে এমনভাবে তৈরি করে দেন যে, মন চাইলেও তাঁরা আর গুনাহ করার পরিবেশ পান না।

ভক্তবৃন্দ সামনে থাকলে; একে কি গুনাহ করার পরিবেশ বলা যায়! মসজিদ মাদরাসা কিংবা খানকাহয় কি গুনাহ করার পরিবেশ পাওয়া যায়! কুরআন মজিদ কিংবা দীনী কোনো কিতাব শিথানের আশেপাশে থাকলে বাজে চিন্তা কি আর মাথায় আসতে পারে! আল্লাহর মহব্বত অন্তরে বহমান থাকলে এসব নেক পরিবেশে গুনাহ করার মত সাহস কি বাকি থাকতে পারে!? আর একজন আল্লাহর ওলি তো এসব পরিবেশেই তাঁর জীবনটাকে পার করে দেন।

এজন্যই বলেছি, আল্লাহর ওলিদের অন্তরেও গুনাহের চিন্তা আসে। তবে আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে ভালোবাসেন তাই তাঁদেরকে মাহফুজ করে রাখেন। তাঁদেরকে সেইভ করেন।

ইবলিস হলো আমাদের অদৃশ্য শত্রু। আল্লাহর কাছে আমরা যত বেশি ইবলিস থেকে পানাহ চাইতে পারবো তত বেশি আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক করতে পারবো। আল্লাহ তাআলা আমাদের পক্ষে ইবলিসের তত বেশি মুকাবেলা করবেন, ততবেশি আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করবেন। আল্লাহ আল্লাহর ওলিদেরকে এভাবেই হেফাজত করেন। অন্যথায় গুনাহ করতে মনে চায় না জগতে এমন কেউ নাই।

হারাম চাকরি করি ছেড়ে দিব না কী করব?

তো যে ব্যক্তি বেকার তার অন্তরে গুনাহের চিন্তাটা বেশি আসে। এইজন্য বেকারত্ব ঠিক নয়। গত কাল একজন প্রশ্ন করেছিল, হারাম চাকরি করি ছেড়ে দিব না কী করব? আমি বলেছিলাম, হারাম চাকরি করা অবশ্যই খারাপ এবং কবিরা গুনাহ। তবে বেকারত্ব এর চাইতে বড় সমস্যা। কারণ, এখন তো আপনি একটা কবিরাহ গুনাহ করছেন। আর বেকারত্ব আপনার জীবনে শত শত কবিরাহ গুনাহর জন্ম দিবে। চাঁদাবাজি সন্ত্রাসীকাণ্ড থেকে শুরু করে গভীর রাতের মোবাইলের গুনাহ পর্যন্ত যত প্রকার আসক্তি আছে, সবগুলো জন্ম দিবে এই বেকারত্ব।

বেকার লোক সবার চাইতে ব্যস্ততা বেশি দেখায়

হাসান বসরি রহ. বলতেন, ‘তুমি হয় দীনের কাজে ব্যস্ত থাকো আর না হয় দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত থাকো।’ দেখবেন, যে লোকের কোন কাম-কাজ নাই, দাওয়াত ও তাবলিগের ভাইয়েরা গেছে তার কাছে দাওয়াত নিয়ে। বলল, ভাই! চলো না তোমারতো এখন কোন কাম-কাজ নেই! একটু সময় আল্লাহর রাস্তায় দাও। তখন দেখবেন যে, সে এর আগেই বড় মসজিদের খতিব হয়ে বসে আছে! এখন তার হাতে কোনো সময় নেই।  প্রচণ্ড ব্যস্ত সে। আসলে যার হাতে কাজ থাকে না তার কাছে ফালতু কাজের কোন অভাব থাকে না। বস্তুত এগুলো কাজ নয়; অকাজ। এগুলো সব আকাম।

কাজ নাই এটা কোন মুমিন বলতে পারে না

কাজ নাই এটা কোন মুমিন বলতে পারে না। কেননা, মুমিনতো কিয়ামতের দিন আফসোস করবে ওই সময়টার জন্য যে সময়টায় তার আল্লাহর জিকির ছিলো না। তাহলে বল, তোমার কাজ নাই এটা তুমি কিভাবে বল? রাসুলুল্লাহ ﷺ যথার্থ বলেছেন, نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنْ النَّاسِ এমন দু’টি নিয়ামত আছে, যে দু’টোর সঠিক মূল্যায়ন না করার কারণে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হচ্ছে, الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ সুস্থতা আর অবসর থাকার নিয়ামত। (বুখারী ৬০৪৯)

সুতরাং অবসর থাকাটা যেন শয়তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণ না হয়। শয়তানের সঙ্গে সঙ্গ দেয়ার কারণ না হয়। বরং অবসর থাকাটা যেন আল্লাহর সাথে সঙ্গ দেয়ার কারণ বনে যায়।

تمنا ہے کہ اب کوئی جگہ ایسی کہیں ہوتی
اکیلے بیٹھے رہتے یاد ان کی دل نشیں ہوتی

‘তামান্না আমার যদি পেতাম এমন কোনো নির্জনতা; একাকী বসে ভাবতাম তাঁকে দূর করতাম অস্থিরতা।’

সুতরাং শোকর আদায় কর, তুমি জিকির করার সময় পাচ্ছ। শোকর আদায় কর, নফল আমল করার সময় পাচ্ছো। শোকর আদায় কর, দীনের কাজ করার সময় পাচ্ছো। শোকর আদায় কর দীনের খেদমত করার সুযোগ পাচ্ছো। শোকর আদায় কর, মসজিদে সময় দেয়ার সময় পাচ্ছো। শোকর আদায় কর একজন আল্লাহওয়ালার কাছে যাওয়ার সময় পাচ্ছো। যদি তুমি ব্যস্ত হয়ে যেতে তাহলে এই সময়গুলো তুমি পেতে না। তাহলে তুমি কিভাবে তোমার এই সময়টাকে নষ্ট করে দিচ্ছো!

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. এর কাছে এক যুবক এসে বললো, হযরত! আমল করতে পারি না। ইবনে আব্বাস রাযি. জিজ্ঞেস করলেন, কেন? যুবক উত্তর দিল, إني كسلان আমি অলস। তাই সময় কেটে যায়, আমল করতে পারি না। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. তখন যুবককে বললেন, و إني أكره أن يقول الناس إني كسلان আর আমি এই কথা কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না যে একজন লোক বলবে, আমি অলস। (মুসান্নাফ ইবনি আবী শাইবা ৯/৬৭)

আসল কাজ তো আখিরাত কামানো

বেকারত্ব একজন মানুষের জীবনকে ধংস করে দেয়। কোন মুমিন বেকার থাকতে পারেনা। টাকা পয়সা ইনকাম করার নাম কাজ নয়; আসল কাজ তো আখিরাত কামানোর নাম। সুতরাং টাকা পয়সা ইনকাম করার কাজে না থাকলেই সে বেকার নয়! কী আশ্চর্য! এটা তো বস্তুবাদী চিন্তা। কুফরি চিন্তা। বস্তুবাদ আমাদের মনে এই চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, যে ব্যক্তি টাকা পয়সা ইনকাম করে না, সে বেকার। আর যে ব্যক্তি টাকা পয়সা ইনকাম করে সেই চালাক, বুদ্ধিমান। অথচ প্রকৃতপক্ষে সবচাইতে বেশি চালাক এবং বুদ্ধিমান কে? রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ

যে ব্যক্তি নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং মৃত্যুর পরের জন্য নেকির পুঁজি সংগ্রহ করেছে, সে ব্যক্তিই প্রকৃত সবল ও বুদ্ধিমান। (তিরমিজি ২৪৪২)

আল্লাহ আমাদেরকে টাকা পয়সার লোভ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন (আমিন)।

আসক্তির পঞ্চম কারণ: গুনাহকে হালকা মনে করা

কোনো গুনাহর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ার পঞ্চম কারণ হল, যে গুনাহটাতে সে অভ্যস্ত ওটাকে সে বড় করে দেখছে না। এখান থেকে তার বের হতে হবে এই চিন্তাটা সে নিচ্ছে না। এটাকে সে হালকা মনে করে বসে আছে। বরং সে কিছু মোয়া খেয়ে বসে আছে। মোয়া বুঝেন তো? মানে যেটা বাস্তবে নাই। খেয়ালি পোলাও। ছোটবেলায় পোলাও রান্না করে না? এরপরে পোলাও রান্না হয়ে গেলে কী করে? সব খেয়ে ফেলে। কী দিয়ে রান্না করে? বালি দিয়ে, এটা সেটা দিয়ে। এগুলো আসলে কি পোলাও না খেয়ালি পোলাও? তো কিছুলোক আছে, এরকম খেয়ালি পোলাও খেয়ে বসে আছে। তার চিন্তা হল এরকম–জীবনটাই কয় দিনের! এখনই যদি সুফি সাহেব বনে যাই, এখনই যদি দীনদার হয়ে যাই তাহলে তো সব শেষ! সুতরাং এখন যেমন তেমন চলুক না! সমস্যা কী! এখন খাও দাও ফুর্তি করো। এরপর শেষ বয়সে একটা চিল্লা মেরে দিব। একটা হজ করে নিব। দাঁড়ি টুপি ধরে ফেলব, ব্যাস! পুরোদমে ভালো হয়ে যাবো।

মূলত এধরণের দৃষ্টিভঙ্গিও আসক্তির অন্যতম কারণ। ফলে যে গুনাহে সে আসক্ত সেখান থেকে সে বের হতে পারে না।

জীবন তোমার যেমন হবে, মরণ তোমার তেমন হবে

হাসান বসরি রহ. বলতেন,

أَمْسُ أَجَلٌ، وَالْيَوْمُ عَمَلٌ، وَغَدًا أَمَلٌ
গতকাল তোমার হাতে নেই, সেটা শেষ। বর্তমান তোমার হাতে আছে, এটা আমলের। আর আগামী কালও তোমার হাতে নেই, কেননা, সেটা প্রত্যাশা ছাড়া কিছু নয়। (আদাবুদদুনয়া ওয়াদ্দীন ১৩৭)

সুতরাং আমি সারা জীবন গুনাহের উপরে থাকবো আর বুড়ো বয়সে এসে হঠাৎ করে ভালো হয়ে যাবো, তাওবা করে নিব, নিজেকে সংশোধন করে নিব–এটা কেবলই প্রত্যাশা। বাস্তবে তা হবে কিনা, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। বরং রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,  کَمَا تَعِیشُونَ تَمُوتُونَ জীবন তোমার যেমন হবে, মরণ তোমার তেমন হবে। وَ کَمَا تَمُوتُونَ تُبْعَثُونَ আর যেমন তোমার মরণ হবে, তেমন তোমার হাশর হবে। (আসসীরাতুল হালাবিয়্যা ১/২৭২)

বুড়ো বয়সে তো  জালিম বাঘও আল্লাহর ওলি হয়!

শেখ সা’দী রহ. বলেন,

در جوانی توبہ شیوہ پیغمبری
وقت پیری گرگ ظالم می شود پرہیزگار

যৌবনকালে তাওবা করা নবীদের শিক্ষা। বুড়ো বয়সে তো অত্যাচারী নেকড়েবাঘও আল্লাহর ওলি হয়।

বুড়ো বয়সে নেকড়ে-বাঘও আল্লাহর ওলি হয় মানে কি? অর্থাৎ বুড়ো বয়সে নেকড়ে-বাঘ শিকার করতে পারে না। এজন্য সে সুফি সাহেব সাজে! বলে, আমি এগুলো বাদ দিয়ে দিয়েছি। এখন আমি আর কারও উপর আক্রমন করি না, ভালো হয়ে গেছি। অনুরূপভাবে বুড়া বয়সে তো আর গুনাহ করতে পারে না! এজন্য বলে, আমি ভালো হয়ে গেছি, এগুলো এখন আর করি না!

যৌবনের তাওবা আল্লাহ তাআলা বেশি কবুল করেন

যৌবনের তাওবা আল্লাহ কেন বেশি কবুল করেন? রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

وَشَابٌّ نَشَأَ في عِبَادَةِ اللَّهِ

যে যুবক আল্লাহর ইবাদতের ভিতর গড়ে উঠেছে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন আরশের নিচে ছায়া দিবেন। (বুখারী ১৪২৩ মুসলিম ১০৩১)

দেখুন, আরশের নিচে ছায়ার সাথে সম্পৃক্ত যে সাতটা আমলের কথা প্রসিদ্ধ হাদিসে এসেছে, অধিকাংশই যৌবনের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন আরেকটি দেখুন,

وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ إلى نَفْسِهَا، قالَ: إنِّي أَخَافُ اللَّهَ

এমন ব্যক্তি যাকে সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী (অবৈধ মিলনের জন্য) আহবান জানিয়েছে। তখন সে বলেছে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।

এই আহবান করাটা ছবিতে হতে পারে, ভিডিওতে হতে পারে, কথিত সেলিব্রেটি হতে পারে, নাচ হতে পারে , গান হতে পারে, মুভি হতে পারে, বাস্তবে হতে পারে। এই সবই হচ্ছে আহবান করা বা invite করা। একটা মেয়ে তোমাকে invite করেছে নানাভাবে অঙ্গভঙ্গি দিয়ে, গান দিয়ে, বাদ্য দিয়ে, অভিনয় দিয়ে অথবা বাস্তব জীবনে। আর তুমি ওই সময়ে বলেছ, إنِّي أَخَافُ اللَّهَ দেখতে তো মনে চায়–কিন্তু আমি দেখব না, কারণ আমি আল্লাহকে ভয় করি। আমার তো মনে চায়, রাতের দুইটায় উঠে একটা খারাপ কাজ করি। কিন্তু আমি করব না, কারণ إنِّي أَخَافُ اللَّهَ আমি আল্লাহকে ভয় করি। আমারতো মনে চায়, পরনারীর ফটো দেখতে ভিডিও দেখতে তার প্রতি কুদৃষ্টি দিতে–কিন্তু আমি তা করবো না। কারণ إنِّي أَخَافُ اللَّهَ আমি আল্লাহকে ভয় করি। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, এই যুবককে কিয়ামতের দিন আরশের নিচে ছায়া দেয়া হবে।

আরেকটি আমল দেখুন, এটাও অনেকটা যৌবনের সাথে সম্পৃক্ত। নবীজি ﷺ বলেন,

وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ في خَلَاءٍ فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ

যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাতে আল্লাহর ভয়ে তার চোখ হতে অশ্রু বের হয়ে পড়ে। (বুখারী ১৪২৩ মুসলিম ১০৩১)

যৌবনের তাওবা আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয় কেন?

বাস্তব অভিজ্ঞতা হল এই, একজন যুবক তওবা করার পরে যে পরিমাণ চোখের পানি দিতে পারে, যে পরিমাণ আল্লাহর কাছে লজ্জিত হতে পারে, যে পরিমাণ ভালো হতে পারে, যে পরিমাণ কাঁদতে পারে, যে পরিমাণ  দীনের ফিকির তার মাথায় আনতে পারে, যে পরিমাণ দীনের মহব্বত তার অন্তরে আসে, যে পরিমাণ আল্লাহপ্রেম-নবীজির প্রতি ভালোবাসা তার অন্তরে আসে, দীনের জন্য জান কুরবানি করার চিন্তা যে পরিমাণ তার মাঝে আসে–একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধ এর চাইতে বেশি তাওবা করে, এর চাইতে বেশি ইস্তেগফার করে এই পরিমাণ কাঁদতে পারে না, এই পরিমাণ আল্লাহর মুহাব্বত অন্তরে আনতে পারে না! একারণেই যৌবনের তওবা আল্লাহ তাআলা বেশি পছন্দ করেন।

যুবকের তাওবা আর বৃদ্ধের তাওবার মাঝে পার্থক্য

বুড়া মিয়া যদি তওবা করে তাহলে কেবল তার লাভ। আল্লাহ যদি তওবা কবুল করেন, তওবা করে জান্নাতে চলে যাবে। কিন্তু যুবক যদি তওবা করে তাহলে নিজে জান্নাতে যাবে, পরিবারকে জান্নাতে নিবে। পরবর্তী জেনারেশনকে জান্নাতি বানিয়ে যাবে। কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত জেনারেশনের ঈমান হেফাজত করার ফিকির করে যাবে।

বুড়া মিয়া তওবা করলেও যদি তার মেয়ে আগে থেকেই বেপর্দায় চলে তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েকে তো আর পর্দায় আনতে পারে না! নিজের ছেলেকে তো আর পরিবর্তন করতে পারে না। আওলাদকে তো আর হেদায়েতের মশাল দিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু যুবক তওবা করেছে তো ছেলেকে দিয়ে দিয়েছে দীনের পথে। যুবক তওবা করেছে তো ছেলেকে আলেম বানিয়েছে। যুবক তওবা করেছে তো ছেলেকে হাফেজ বানিয়ে দিয়েছে। যুবক তওবা করেছে তো ছেলের জন্য দোয়া করেছে যে, ওগো আল্লাহ! আপনি আমার সন্তানকে মুজাহিদ বানান। যুবক তওবা করেছে তো ছেলের জন্য দোয়া করেছে, ওগো আল্লাহ! ছেলেকে আলেম বানান। আমি আলেম হতে পারে নাই, আমাকে আলেমের আব্বা বনিয়ে দেন। যুবক তওবা করেছে তো ছেলের জন্য দোয়া করেছে, ওগো আল্লাহ! ছেলেকে শহিদ হিসেবে আর আমাকে শহিদের বাবা হিসেবে কবুল করে নিন। এটাই হলো যুবকের তওবা আর বৃদ্ধের তওবার মধ্যে পার্থক্য! আল্লাহ আমাদেরকে যৌবনে তওবা করার তাওফিক দান করুন (আমিন)।

যাই হোক, যেটা বলতে চেয়েছিলাম যে, কোনো গুনাহর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ার একটা কারণ হল, যে গুনাহটাতে সে অভ্যস্ত ওটাকে সে বড় করে না দেখা। ওটাকে হালকা মনে করা। তার চিন্তা হল, এ আর তেমন কী! বুড়ো বয়সে তওবা করে নিলেই বেড়া পার! অথচ এটা ভুল চিন্তা। একজন মুমিন এধরণের চিন্তা লালন করতে পারে না। গুনাহ সম্পর্কে মুমিনের দৃষ্টিভঙ্গি তো এমন হবে যে, নবীজি ﷺ বলেন,

إنَّ المُؤْمِنَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَأنَّهُ قاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخافُ أنْ يَقَعَ عليه

ঈমানদার ব্যক্তি তার গুনাহগুলোকে এত বিরাট মনে করবে, যেন সে একটা বিশাল পাহাড়ের নীচে বসে আছে, আর সে আশঙ্কা করছে যে, সম্ভবত পর্বতটা তার উপর ধ্বসে পড়বে।

নবীজি ﷺ বলেন, পাপিষ্ঠ কিংবা মুনাফিকরাই গুনাহকে হালকা মনে করে। ঈমানদার গুনাহকে হালকা মনে করতে পারে না। নবীজির ভাষায়,

وإنَّ الفاجِرَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَذُبابٍ مَرَّ علَى أنْفِهِ فقالَ به هَكَذا

পাপিষ্ঠ ব্যক্তি তার গুনাহগুলোকে মাছির মত মনে করে, যা তার নাকে বসে চলে যায়। (বুখারী ৬৩০৮)

আসক্তির ষষ্ঠ কারণ: রাস্তার হক আদায় না করা

গুনাহয় আসক্ত হয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হল, রাস্তার হক আদায় না করা। বলতে পারেন, এটা কেমন কথা!?  হ্যাঁ এটাই কথা। রাস্তার হক পূরণ না করলে একজন মানুষ ধীরে ধীরে গুনাহে এডিক্টেড হয়ে যায়। আমাদের অভ্যাস হল, আমরা রাস্তায় যখন চলি তখন তামাশা দেখি। কোথাও একটু হুহু করে উঠলে দেখি কী হয়েছে! কোথাও একটু কিছু  ঘটলে দেখি কি হয়েছে। এবার জড়ো হয়ে যায় সবাই। এই যে এই ছোট খাটো বিষয়গুলো একজন মানুষকে যে কোন কিছুতে আসক্ত করে দিতে পারে। প্রশ্ন হল, কিভাবে? তাহলে আগে হাদিস শুনুন, আবু সাইদ খুদরি রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

إيَّاكُم و الجلوسَ في الطُّرُقاتِ قالوا يا رسولَ اللهِ ‍ ما لنا بُدٌ من مجالِسِنا نَتحدَّثُ فيها ، فقال ﷺ : أما إذا أَبيتُمْ ، فَأَعطُوا الطَّريقَ حَقَّهُ قالوا : و ما حَقُّ الطَّريقِ يا رسولَ اللهِ ؟ قال : غَضُّ البصرِ ، و كَفُّ الأذَى ، و الأَمرُ بالمعروفِ ، و النَّهيُ عنِ المنكَرِ

তোমরা রাস্তা বা মানুষের চলাচলের পথে বসা থেকে বিরত থাক। সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! রাস্তায় বসা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নাই আমরা রাস্তায় বসে কথা-বার্তা বলি-আলোচনা করি। রাসূল বললেন, যদি তোমাদের বসতেই হয়, তাহলে তোমরা রাস্তার হক আদায় কর। সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! রাস্তার হক কী? তিনি বললেন, চক্ষু অবনত করা, কষ্টদায়ক বস্তু পথের থেকে সরানো, সালামের উত্তর দেয়া, সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা। (বুখারী ২৪৬৫)

উক্ত হাদিসে রাস্তার প্রথম হক হিসেবে বলা হয়েছে, দৃষ্টি সংযত রাখা। এবার বুঝেছেন রাস্তার হক আদায় না করলে কেন একজন মানুষ আসক্তির ব্যধিতে আক্রান্ত হতে পারে? কারণ দৃষ্টি হেফাজত না করলে মানুষ এ ব্যধিতে আক্রান্ত হতে পারে। একটা মেয়ের প্রতি আকর্ষণই তো একটা সময় নেশাখোর বানিয়ে দিতে পারে, ইয়াবখোর বানিয়ে দিতে পারে, একটা সময় গাঁজাখোর বানিয়ে দিতে পারে।

রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা

রাস্তার দ্বিতীয় হক হচ্ছে, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা। সুতরাং যেখানে সেখানে পার্কিং নয়। যেখানে সেখানে সাইকেল, হুন্ডা, গাড়ি রাখা নয়। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা নয়। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা নয়। কেননা, এর কারণে আমি দুর্ঘটনায় পড়তে পারি কিংবা অন্য কেউ দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। এগুলো রাস্তার হক। মানুষ চলাচল করতে যেয়ে কষ্ট হয় এমন জিনিস আমি রাস্তায় রাখবো না, ফেলবো না।

সালামের জবাব দেয়া

রাস্তার তৃতীয় হক হচ্ছে, সালামের জবাব দেয়া। রাস্তার এই হকটি আদায় করতে পারলে সবচাইতে বড় যে ব্যপারটা আপনার জীবনে ঘটে যাবে তাহল, আপনার মনের অজান্তে আপনার মধ্যে বিনয় চলে আসবে। আপনার মধ্যে নিজের দোষ দেখার মানসিকতা তৈরি হবে।

সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা।

রাস্তার চতুর্থ হক হচ্ছে, সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা। এটাতো এখন নাই বললেই চলে। এর কারণে কোনখানে আবার রাষ্ট্রদ্রোহি মামলায় পড়ে যাই কিনা! জঙ্গিবাদের মামলায় পড়ে যাই কিনা! বাস্তবতা হল, আমরাও এখন ভয়ে থাকি। তারা যতটুকু আমাদেরকে বেচারা মনে করে দীন পালন করতে দেয়, আমরাও ততটুকুই পালন করি। এর চাইতে বেশি পালন করতে আমরা পারি না। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। যাই হোক, তবুও আমরা চেষ্টা করবো নিজেদের সাধ্য অনুপাতে এই হক আদায় করার।

আজকের আলোচনায় আমরা আসক্তি সম্পর্কে জানলাম, চিনলাম। আসক্তির কারণগুলোও জানলাম। ইনশাল্লাহ, আগামী আলোচনায় আমরা আসক্তির চিকিৎসা সম্পর্কে জানবো। পরিশেষে দোয়া করি, আল্লাহ আমাদেরকে আসক্তি থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। যাবতীয় আসক্তি থেকে আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।