আদাবুযযুনূব
(পর্ব ০২)
তাওবার তাওফিক কার হয় না?
তাওবার তাওফিক কার হয় না? যার জিন্দেগিতে এস্তেগফার নাই, তাওবার তাওফিক তার হয় না। যার জিন্দেগিতে ইস্তেগফার বেশি আছে আল্লাহ তাকে তাওবার তাওফিক দিয়ে দেন।
সাহাবায়ে কেরাম রাযি. বলতেন এবং এটা হাদীসও যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَا أَصَرَّ مَنِ اسْتَغْفَرَ وَإِنْ عَادَ فِي الْيَوْمِ سَبْعِينَ مَرَّةً
যে ব্যক্তি দিনে সত্তরবার করে একই গুনাহ করার পরও আল্লাহর কাছে গুনাহের জন্য ক্ষমা চাইবে, (ইস্তেগফার করবে) সে যেন প্রকৃতপক্ষে গুনাহ বার বার করে নি। (তিরমিযী ৩৫৫৯)
অর্থাৎ, সে ব্যক্তি বেশি ইস্তেগফার করার কারণে শেষ পর্যন্ত ওই গুনাহের উপর অটল থাকতে পারে না; বরং সে তাওবা করে নেয়।
সুতরাং আপনার জিন্দেগিতে যত বেশি ইস্তেগফার থাকবে তাওবা তত সুন্দর হবে। ইস্তেগফার আর তাওবা যদি না থাকে তবে একটা গুনাহ শুরু হবে সুতা দিয়ে শেষে বিশাল মোটা রশি হয়ে যাবে। একটা সুতা সহজেই ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব।
তাওবার একটি দৃষ্টান্ত
একবার আমরা কয়েকজন ফেরি দিয়ে আসছিলাম। সম্ভবত মাদারীপুর থেকে। রাত ২-৩ টা হবে। দেখলাম যে, ফেরিটাকে বেঁধে রেখেছে বিশাল মোটা দড়ি দ্বারা। একটার সাথে একটা পেঁচানোর পরে দড়িটা এরকম মোটা হয়েছে। এখন সে এত শক্তিশালী যে, একটা ফেরিকে ধরে রেখেছে। যে ফেরির ভিতরে বিভিন্ন গাড়িসহ কয়েক টন মাল আছে। কিন্তু দড়িটা যদি আলাদা আলাদা হত, এত শক্তিশালী হত? হতো না। যখন আপনি একটা গুনাহ করেন, তাওবাটা করে ফেলেন । দেখবেন ঐ রশিটা ছিঁড়ে গেছে। এটার সাথে আরেকটা জোড়া লাগতে পারে নাই। নবীজী ﷺ এটাই বলেন,
إِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا أَذْنَبَ كَانَتْ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ فِي قَلْبِهِ فَإِنْ تَابَ وَنَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ صُقِلَ قَلْبُهُ
যখন কোন মুমিন একটি গুনাহ করে তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে, তারপর যখন সে তাওবা করে গুনাহটি অপসারণ করে এবং ইস্তিগফার করে তখন তার অন্তর চকচকে পরিষ্কার হয়ে যায়। ( মুসনাদে আহমাদ ৭৯৫২)
ইস্তেগফারের স্তূপ গড়ে তুলুন
ইস্তেগফার আপনার জিন্দেগিতে এত বেশি করুন, এত বেশি পড়ুন যেন ইস্তেগফারের স্তূপ লেগে যায়। বলতে পারেন, কী পরিমাণ পড়ব? আমি বলব, আপনার জিন্দেগিতে যতটা সেকেন্ড ততটা সেকেন্ড আপনি ইস্তেগফার পড়েন। আপনি বলতে পারেন, কেন? আমি বলব, আমাদের জিন্দেগির প্রতিটা সেকেন্ড গুনাহের ভিতর অতিবাহিত হয়। বলতে পারেন, না, হুজুর! আমরা তো ইবাদত করি। আমি বলব, ইবাদতের ভিতরে যখন রিয়া আসে তখন প্রতিটা সেকেন্ড গুনাহ হিসেবে কাউন্ট হয়ে যায়। আমরা ফেসবুক দেখতে দেখতে, ইউটিউব দেখতে দেখতে ঘুমাই। ফলে আমাদের ঘুমও গুনাহের ভিতরে চলে যায়। তাই আমি বলব, যেহেতু আমাদের প্রতিটা সেকেন্ড গুনাহের ভিতর কাটে, তাই প্রতিটা মুহুর্তে আমার যেন একটা ইস্তেগফার থাকে। সুতরাং ইস্তেগফার কত বার করবেন; এই প্রশ্ন নাই। যতবার গুনাহ হয়েছে ততবার করবেন। ইস্তেগফার যত পড়বেন গুনাহ তত হালকা হতে হতে থাকবে। চোখের পানি আনা লাগবে না; বরং গুনাহর কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে টপ করে চোখের পানিও পড়ে যাবে। আর আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে এক ফোঁটা চোখের পানি দিয়ে সব গুনাহ ধুয়ে মুছে দিবেন। কেননা, চোখের পানিতে রয়েছে এটমিক পাওয়ার। চোখের পানি কেবল এক দু’টি নয়; বরং بُحُورًا مِنْ نَارِ جَهَنَّمَ জাহান্নামের আগুনের বহু সমুদ্রকে নিভিয়ে দিতে পারে। (কিতাবুযযুহদ পৃষ্ঠা ০৪)
আপনি হয়ত মনে করতে পারেন আমার গুনাহ বেশি আল্লাহ মাফ করবেন কিনা? আমি আপনাকে বলব, আপনি কুরআন হাদিসের একটা জায়গা দেখান যেখানে আছে আল্লাহ বেশি গুনাহ মাফ করতে পারেন না, কম হলে পারেন! বড় গুনাহ মাফ করা আল্লাহর কাছে কঠিন আর ছোট গুনাহ মাফ করা সহজ বিষয়টা কি এমন? এমন নয় । বিষয় হল, আমি আল্লাহর কাছে তাওবা করেছি কিনা। যদি আমি তাওবা করি তাহলে বড় -ছোট কোন বিষয় নয়, বেশি-কম কোন বিষয় নয়, আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করে দিবেন ।
মুনাজাতে কান্নাকাটি আসে না কেন?
অনেকে অভিযোগ করেন যে, মুনাজাতে কান্নাকাটি আসে না। আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, মুনাজাতে কান্নাকাটি আসে না কেন? তিনি উত্তরে বলেন, من كثر ذنبه قل بكاءه যে ব্যক্তির গুনাহ বেশি তার কান্নাকাটি আসে কম।
সুতরাং তুমি ইস্তেগফার দিয়ে গুনাহকে হালকা করে দাও, আল্লাহ তাআলা কান্নাকাটির দৌলত এমনিতেই নসিব করে দিবেন। আল্লাহর ভয়ে চোখের পানি তো এমন দৌলত যে, এক ফোঁটা দিবেন জাহান্নামের আগুন মাফ, গাল পর্যন্ত আসবে কিয়ামতের ময়দানে শাস্তি মাফ হয়ে যাবে, দাঁড়ি ভিজবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের ময়দানে বেইজ্জতি করবেন না, জমিন ভিজবে ঐ চেহারা কিয়ামতের ময়দানে ক্লান্ত শ্রান্ত হবে না, বিনা ইচ্ছায় হেঁচকি দিয়ে কান্না চলে এসেছে তাহলে এর উসিলায় মজলিসের সবাইকে আল্লাহ মাফ করে দিবেন। এই যে আমি যতগুলো কথা বলেছি সবগুলো কথাই হাদিস থেকে।
ইস্তেগফারের ফায়দা
যাই হোক, গুনাহের সাথে আমাদের প্রথম আচরণ হবে তাওবা করা। আর তাওবা সহজ করার জন্য অধিকহারে ইস্তেগফার করতে হবে। যার জিন্দেগীতে ইস্তেগফার নাই তার তাওবা নসীব হয় না। যুবকেরা অনেক সোময় বেকারত্বের টেনশনে থাকে, বিভিন্ন ধরনের পেরেশানিতে থাকে ইস্তেগফার করলে আল্লাহ এগুলোও দূর করে দেন । ইস্তেগফারের ফায়দা এত বেশি যে, বলে শেষ করা যাবে না। হাদিসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত নবীজী ﷺ বলেন,
مَنْ لَزِمَ الِاسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا ، وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا ، وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
যে ব্যক্তি সর্বদা ইস্তেগফার করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে প্রতিটি চিন্তা হতে মুক্ত করে দিবেন, প্রতিটি সংকীর্ণতা হতে তার বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করে দিবেন এবং তাকে বেহিসাব রিয্ক দান করবেন। (আবু দাউদ ১৫১৮)
দুই. গুনাহকে ছোট করে না দেখা
গুনাহর সঙ্গে আমাদের দ্বিতীয় যে আচরণ দেখাতে হবে তা হল, যদি কোন গুনাহ হয়ে যায় তখন এটাকে বিশাল কিছু মনে করব যে, আমার একটা বিশাল ক্ষতি হয়ে গেছে। আপনি যত বেশি এই মানসিকতা লালন করতে পারবেন আপনার গুনাহটা তত হালকা হয়ে যাবে।
গুনাহ হল আমাদের শত্রু। শত্রুর ক্ষেত্রে যুদ্ধের কৌশল হল শত্রুকে কখনো ছোট করে দেখতে নাই। শত্রুকে হালকা করে দেখলে সে শক্তি সঞ্চয় করে পুনরায় আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। আর শত্রুকে বড় কোরে দেখলে সে এই সুযোগটা পায় না। কারণ আপনি তখন সম্পূর্ন সতর্ক। একটা ছোট সাপের বাচ্চা । আদর করে মারলেন না। কিন্তু যদি সে কামড় দেয় তাহলে? এজন্যই গুনাহের ক্ষেত্রে আমাদের আচরণ হবে এমন কোন গুনাহকেই আমরা ছোট মনে করব না। হালকা করে দেখবো না।
হাদিসে এসেছে নবীজী ﷺ বলেন,
إياكم ومُحَقَّراتِ الذنوبِ
তুমি ঐ সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাক যেগুলোকে ছোট বলে ধারণা করা হবে। (সহিহ আলজামি’ ২৬৮৬)
একটা জিনিস চিন্তা করে দেখুন, হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি একটা বিড়ালকে বেঁধে রাখার কারণে জাহান্নামে চলে গেছে। একজন মুজাহিদ শুধু একটা রশি চুরি করার কারণে জাহান্নামে চলে গেছে। আরো এসেছে, একজন লোক আমল করতে করতে জান্নাতের পাড়ে চলে যায়, তারপর সে হঠাত একটা কথা বলে যার কারণে সে জাহান্নামের পাড়ে চলে আসে।
তাহলে বলুন, কোন গুনাহকে ছোট মনে করে দেখার কোন সুযোগ আছে?!
একজন মুমিন সগিরাকেও কবিরা গুনাহ মনে করে
মূলত একজন মুমিন বান্দা সগিরাকেও কবিরা মনে করে। হাদিসে এসেছে, নবীজী ﷺ বলেন, ঈমানদার ব্যক্তি তার গুনাহগুলোকে এত বিরাট মনে করে, যেন সে একটা পর্বতের নীচে উপবিষ্ট আছে, আর সে আশঙ্কা করছে যে, সম্ভবত পর্বতটা তার উপর ধ্বসে পড়বে। আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি তার গুনাহগুলোকে মাছির মত মনে করে, যা তার নাকে বসে চলে যায়। (বুখারী ৬৩০৮)
এজন্যই হাকিমুল উম্মত থানবী রহ. বলতেন, তোমরা সগিরা আর কবিরা গুনাহের মধ্যে পার্থক্য কর। অথচ তোমরা কি দেখ না, একটা ছোট আগুনের কয়লাও বড় একটা তুলার গুদামকে জ্বালিয়ে দিতে পারে যেভাবে দাউ দাউ করা আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে ।
কবি বলেন,
لاَ تَحْقِرَنَّ صَغِيْرَةً إِنَّ الْجِبَالَ مِنَ الْحَصَى
গুনাহকে ছোট মনে করো না। বড় পাহাড় ছোট ছোট পাথর দিয়েই তৈরি হয়।
আমরা যেমন আমাদের প্রবাদও তেমন। আমরা নাচি। তাই আমাদের প্রবাদও হল, নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা। সালাফগণ যেমন ছিলেন, তাঁদের প্রবাদগুলোও তেমন ছিল। তাঁদের মাঝে প্রবাদ ছিল,
لا تنظر إلى صغر الذنب وانظر إلى عِظَم مَنْ خالفت
তুমি এটা দেখো না যে, সগিরা গুনাহ করছ; বরং তুমি এটা দেখ যে, তুমি কার নাফরমানি করছ!
সুতরাং গুনাহের সাথে আমাদের দ্বিতীয় আচরণ হল, গুনাহকে ছোট বা তুচ্ছ মনে না করা।
তিন. গুনাহ প্রকাশ না করা এবং প্রকাশ্যে না করা
আমাদের গুনাহ হল দুই ধরণের। প্রকাশ্য গুনাহ এবং গোপন গুনাহ। এ গুনাহগুলো করায় ইবলিস এবং নফস। এ দুই শত্রু থেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের একমাত্র সাহায্যকারী হলেন আল্লাহ। এখন আপনি যদি উল্টা আল্লাহর অহংকারে আঘাত করে বসেন তাহলে আল্লাহ্ সাহায্য করবেন নাকি শত্রুর কাছে ছেড়ে দিবেন? শত্রুর কাছে ছেড়ে দিবেন ।
আল্লাহ তাআলাও একসময় বান্দাকে নফসের কাছে, ইবলিসের কাছে ছেড়ে দেন। কখন জানেন? বান্দা যখন প্রকাশ্য গুনাহ বেশি করে। কেননা, তখন আল্লাহর অহংকারে আঘাত লাগে। নাফরমানি করলি তো করলি এত মানুষের সামনে নাফরমানি করে তুই দেখিয়ে দিলি যে, আল্লাহ! আমি আপনাকে কোন কেয়ার করি না। আমার মাখলুকের সামনে নাফরমানি করে তুই দেখিয়ে দিলি যে, আমি তোমাদের রব আল্লাহকে কোন কেয়ার করি না। এ কারণে যে লোকটা প্রকাশ্যে গুনাহ করে আল্লাহ্ তাআলা তাকে মাফ করেন না। নবীজী নবীজী ﷺ বলেন,
كُلُّ أُمَّتِي مُعَافًى إِلاَّ الْمُجَاهِرِينَ
আমার সব উম্মত মাফ পাবে কিন্তু যে প্রকাশ্যে গুনাহ করেছে সে ছাড়া। (সহীহ বুখারী ৬০৬৯)
গুনাহ করে প্রকাশ করাটাও প্রকাশ্যে গুনাহ করার শামিল
তাহলে কি গোপন গুনাহ করব? না, গোপনেও গুনাহ করব না। কেননা, গুনাহ তো গুনাহই। কিন্তু গোপনে হয়ে যেতে পারে। যদি হয়ে যায় তবে প্রকাশ করব না। রাতে মুভি দেখে ফেলেছি সকালে বলে বেড়াব না যে গতকাল খুব মজার একটা মুভি দেখেছি। কেননা, গুনাহ করে প্রকাশ করাটাও প্রকাশ্যে গুনাহ করার শামিল। নবীজী ﷺ বলেন,
وَإِنَّ مِنَ الْمَجَانَةِ أَنْ يَعْمَلَ الرَّجُلُ بِاللَّيْلِ عَمَلاً، ثُمَّ يُصْبِحَ وَقَدْ سَتَرَهُ اللَّهُ، فَيَقُولَ يَا فُلاَنُ عَمِلْتُ الْبَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا، وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللَّهِ عَنْهُ
আর নিশ্চয় এ বড়ই ধৃষ্টতা যে, কোন ব্যাক্তি রাতে গুনাহ করল যা আল্লাহ গোপন রাখলেন। কিন্তু সে ভোর হলে বলে বেড়াতে লাগল, হে অমুক! আমি আজ রাতে এমন এমন কর্ম করেছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত অতিবাহিত করল যে, আল্লাহ তার কর্ম গোপন রেখেছিলেন, আর সে ভোরে উঠে তার উপর আল্লাহর পর্দা খুলে ফেলল। (সহীহ বুখারী ৬০৬৯)
সুতরাং গুনাহের সাথে আমাদের তৃতীয় আচরণ হবে, প্রকাশ না করা এবং প্রকাশ্যে না করা।
চার. গুনাহ যেন প্রতিক্রিয়াশীল না হয়
কিছু গুনাহ আছে এমন যা কেবল একজনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং অন্যদের মাঝেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আমরা সদকায়ে জারিয়ার কথা শুনেছি। অনুরূপভাবে কিছু গুনাহও আছে এমন যে, জারি থাকে। গুনাহ আমাদের দ্বারা হয়ে যাবে। কিন্তু আমি সবসময় সতর্ক থাকব যেন এমন কোন গুনাহ না হয় যে গুনাহটা জারি।
অনুরূপভাবে কিছু গুনাহ আছে ছোট কিন্তু স্থানের কারণে সেটা বড় হয়ে যায়। যেমন হারাম শরিফ। কুদৃষ্টি দেয়া গুনাহ। কিন্তু হারাম শরিফে বসে দেয়া আরও বড় গুনাহ।
অনুরূপভাবে কিছু সময় আছে যে সময়ে গুনাহকে বড় করে দেখা হয়। যেমন কোনো লোক যদি লাইলাতুল কদরে মাহরুম হয়ে যায় তাহলে নবীজী ﷺ বলেন যে, সব কল্যাণ থেকে মাহরুম হয়ে গেছে। কারণ সে এত বড় সময়টাকে মূল্য দিতে পারে নাই। রমজানে যে নিজেকে মাফ করাতে পারে নাই জিবরাইল আলাইহিস সালাম বলেন, সে আল্লাহর রহমত থেকে দুরে সরে গেল। কেন? কারণ এত বড় রমজান আসল, এত বড় অফার আসল অথচ সে এই অফারটা নিতে পারে নাই। সুতরাং বোঝা গেল, কিছু সময় আছে এমন যে, ওই সময়ে গুনাহ করলে সেটা বড় করে দেখা হয়।
আবার কিছু ব্যক্তি আছে এমন যাদের সামনে গুনাহ করলে সেটা বড় করে দেখা হয়। যেমন, নবীজী ﷺ এক ব্যক্তিকে বললেন, তুমি ডান হাতে খানা খাও। তার মাঝে অহংকার চেপে বসল। সে বলে বসল, আমি ডান হাতে খেতে পারি না। নবীজী ﷺ বললেন, তুমি ডান হাতে খেতেও পারবে না। পরবর্তিতে তার হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল।
আবার কিছু ব্যক্তি আছে এমন, গুনাহটা হয়ত ছোট কিন্তু ঐ ব্যক্তির জন্য গুনাহটা বড়। যেমন ইমাম সাহেব যদি ইস্তেঞ্জার পরে শুধু পানি নেন মুসল্লিদের সামনে। যদিও পানি ও ঢিলার যে কোন একটা নিলেই হয়ে যায়। কিন্তু মুসল্লিরা বলে বসবে, হায়রে আমরা কোন ইমামের পিছনে নামাজ পড়ি, ঢিলা কুলুখ কিছু নেয় না, পানিও খরচ করে না! আমি বলব না যে, লোকটার কোন দোষ নেই। বরং আমি এ কথা বলব যে, ঐ লোকের চেয়ে ইমাম সাহেবের দোষ বেশি। কারণ, নবীজী ﷺ বলেন,
اتَّقُوا مَوَاضِعَ التُّهَمَةِ
তোমার উপর অপবাদ আসতে পারে এমন কথা থেকে, কাজ থেকে, জায়গা থেকে বেঁচে থাক।
সুতরাং আমি একজন ইমাম হিসেবে, একজন দায়ী হিসেবে আমাকে সতর্ক থাকতে হবে। যেখানে সেখানে বসে যাওয়া নয়, যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাওয়া নয়, যেখানে সেখানে চা খাওয়া নয়। কেন? যেন আমার কথার ওয়েট থাকে যেন ব্যক্তিত্ব থাকে এবং যেন দাওয়াতের কাজে সুবিধা হয়। এটা অহংকার না। আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে, বন্ধু বান্ধবের সাথে মজা করেন না? কে আপনাকে ধরে রাখবে? কিন্তু সব জায়গায় যদি সব কাজ করি তাহলে ব্যক্তিত্ব নষ্ট হবে না?
এটা অহংকার নয়; আত্মমর্যাদাবোধ
আল্লাহ তাআলা আমাদের আম্মাজান, রাসূল ﷺ-এর স্ত্রীদের বলেন,
يَا نِسَاء النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاء إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا
হে নবীর স্ত্রীগণ, তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। (সূরা আহযাব ৩২)
উক্ত আয়াতের আলোকে আমি আপনাকে এ কথা বলব যে, আপনি দ্বীনদার, আপনার দাড়ি আছে টুপি আছে; সুতরাং আপনি কিন্তু অন্যদের মত না। এর অর্থ এ নয় যে, আপনি অহংকার করছেন। এটা হল, নিজেকে চেনা। এটাকে বলা হয়, আত্মমর্যাদাবোধ। আত্মমর্যাদাবোধ আর অহংকার এক নয়। অহংকার হল, আমি নিজেকে বড় মনে করলাম আর অন্যকে ছোট মনে করলাম। আর আত্মমর্যাদাবোধ হল, আমি আমার ব্যক্তিত্বকে ঠিক রাখলাম অন্যকে বড় মনে করেই। হজরত থানবী রহ. বলেন, আমি তোমাদের সবার চেয়ে নিজেকে ছোট মনে করি। একজন শাগরেদ বলল, হজরত! এটা কিভাবে সম্ভব! তিনি বললেন, দেখো, আমার অবস্থা হল এমন যে, এক বাদশা একজন দারোয়ান রেখেছে এবং দারোয়ানকে এই নির্দেশ দিয়ে রেখেছে যে, যে লোকই এতটার পরে আসবে এমনকি যদি রাজপুত্রও আসে তবে তাকে গেটের ভিতরে ঢুকতে দিবে না। এখন রাত ১২ টায় আসল রাজপুত্র। দারোয়ান তাকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। এর অর্থ কি রাজপুত্র ছোট আর দারোয়ান বড়? অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলা আমাকে তোমাদের ইসলাহ করার জিম্মাদারি দিয়েছেন, কিন্তু আমি তো দারোয়ান আর তোমরা তো রাজপুত্র।
সুতরাং একদিকে অহংকার করা যাবে না, অপরদিকে বিনয়ের অর্থ এই নয় যে, নিজের ব্যক্তিত্বকে মিটিয়ে দেয়া ।
আমি যদি দাড়ি টুপি পড়ে ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য দোকানে দাঁড়িয়ে থাকি এটা কি ঠিক হবে? তাবলীগ করার পরও যদি আমার বাসায় টেলিভিশন থাকে এটা ই ঠিক হচ্ছে? চিল্লা দিলাম কিন্তু মেয়েকে পর্দা শিখাই না এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমাকে খেয়াল রাখতে হবে যে, আমি তো অন্যদের মত নই ।
যাই হোক, বলতে চেয়েছিলাম, সময়, স্থান, ব্যক্তির কারণে কিছু গুনাহ বড় করে দেখা হয়। এগুলো খেয়াল করে চলা। খেয়াল রাখা যেন আমার গুনাহ যেন জারি না থাকে এবং আমার গুনাহ যেন বড় না হয়ে যায় ।
পাঁচ. গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে একটি নেক আমল করে নেয়া
আগেই বলেছি, গুনাহ হয়ে যাবে। গুনাহ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা নেক আমল করে নিব। নবীজী ﷺ বলেন,
إِنَّ مَثَلَ الَّذِي يَعْمَلُ السَّيِّئَاتِ ثُمَّ يَعْمَلُ الْحَسَنَاتِ: كَمَثَلِ رَجُلٍ كَانَتْ عَلَيْهِ دِرْعٌ ضَيِّقَةٌ قَدْ خَنَقَتْهُ, ثُمَّ عَمِلَ حَسَنَةً فَانْفَكَّتْ حَلْقَةٌ, ثُمَّ عَمِلَ حَسَنَةً أُخْرَى فَانْفَكَّتْ حَلْقَةٌ أُخْرَى حَتَّى يَخْرُجَ إِلَى الأَرْضِ
যে ব্যক্তি কোন গুনাহ করার পরপরই নেক আমল করে, সেই ব্যক্তির উপমা এমন একজনের মত যার দেহে ছিল সংকীর্ণ বর্ম; যা তার শ্বাস রোধ করে ফেলেছিল। অতঃপর সে যখন একটি নেক আমল করে, তখন বর্মের একটি আংটা খুলে যায়। তারপর আর একটি পুণ্য করলে আরো একটি আংটা খুলে যায়। ফলে সে সংকীর্ণতার কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। তখন সে হাফ ছেঁড়ে বাঁচে। (মুসনাদে আহমাদ ১৭৩০৭)
পানির ভিতর যদি কোন ব্যক্তিকে চুবিয়ে ধরে রাখা হয় তারপর যদি ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে কেমন আরাম লাগে। ঠিক তেমনিভাবে একজন মুমিন বান্দা গুনাহ করার পর তার কাছে মনে হয় পানির ভিতর কেউ আমাকে ধরে রেখেছে। তারপর যখন একটা নেক আমল করে তখন মনে হয় ধরা থেকে কেউ ছেড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ, নেক আমল করার পর মুমিনের অন্তরটা প্রশান্ত হয়ে যায়।
ছয়. আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া
গুনাহর সঙ্গে সর্বশেষ আচরণ আপনার যেটা হবে তা হল, কখনো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবেন না। আমরা একটা আয়াত আমরা সচরাচর শুনি, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ অর্থাৎ, গুনাহ করেছে; তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা যুমার ৫৩)
তাফসিরে বগভীতে হযরত ইবনু আব্বাস রাযি. এসেছে, এ আয়াতের শানেনুযুল হল, কিছু লোক ছিল, যারা অন্যায় হত্যা করেছিল এবং অনেক করেছিল। আরও কিছু লোক ছিল, যারা ব্যভিচার করেছিল এবং অনেক করেছিল। তারা এসে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে আরজ করল: আপনি যে ধর্মের দাওয়াত দেন, তা তো খুবই উত্তম, কিন্তু চিন্তার বিষয় হল এই যে, আমরা অনেক জঘন্য গোনাহ করে ফেলেছি। আমরা যদি ইসলাম গ্রহণ করি, তবে আমাদের তওবা কবুল হবে কি? এর পরিপ্রেক্ষিতেই আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয় ৷
আল্লাহর রহমতের আশা যেন তামাশা না হয়
সুতরাং যদি গুনাহর সঙ্গে পেছনের পাঁচ আচরণ দেখাতে পারি, বিশেষ করে প্রথম আচরণ অর্থাৎ, যদি তাওবা করার তাওফিক হয় তবে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হব না। কেননা, ওলামায়েকেরাম বলেছেন, অতীত গুনাহ থেকে তাওবা করার পর আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়াটাও এক প্রকার গুনাহ। পক্ষান্তরে যদি পিছনের পাঁচ আচরণ দেখাতে না পারি বিশেষ করে তাওবা করতে না পারি তবে আল্লাহর আযাবের ভয় থেকে কখনো পালাব না। কেননা, তাওবা না করে কবিরা গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার আশা করাটা আল্লাহর রহমতের আশা নয়; বরং হাকিমুল উম্মত থানবী রহ. বলেন, এটা আল্লাহর রহমতের সাথে তামাশা। এ কারণেই কুরআন মজিদের বিভিন্ন স্থানে এই উভয় দিককে এক সাথেই বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ وَأَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ الألِيمُ
অর্থাৎ, আমার বান্দাদেরকে বলে দাও, নিশ্চয় আমিই চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু এবং আমার শাস্তিই হল অতি মর্মন্তুদ শাস্তি। (সূরা হিজর ৪৯-৫০)
আল্লাহ আমাদেরকে গুনাহের সাথে উক্ত ছয়টি আচরণ দেখানোর তৌফিক দান করুন। আমিন।
আরো পড়ুন আদাবুযযুনূব পর্ব ০১