আদাবুযযুনূব তথা গুনাহর সঙ্গে আমাদের আচরণবিধি কেমন হওয়া চাই

আদাবুযযুনূব

আদাবুযযুনূব

(পর্ব ০১)

শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে আজকেও এখানে আল্লাহর জন্য কিছু সময় বের করার তাওফিক দান করেছেন; আলহামদুলিল্লাহ।

রবকে চেনার অন্যতম আলামত

আমরা প্রত্যেকে এ কথা বুঝি যে, আসলে আমাদের অবস্থা ভয়াবহ। যিনি আপনাদেরকে নসিহত শুনাচ্ছেন অর্থাৎ আমি গুনাহগার এবং যারা শুনছেন অর্থাৎ আপনারা; আমরা কেউই এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্ত নয়।

উপরন্তু আমাদের একটা দোষ আছে সেটা হল, একদিকে নিজেদের অবস্থা খারাপ। অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ, রিয়া, উজব ইত্যাদি আমাদের জীবনকে একেবারে খালি করে দিয়েছে। একেবারে ফোকলা করে দিয়েছে। তবে শোকর আদায় করি এজন্য যে, আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের অনেকের অনুভূতিতে এসেছে। এর কিছু আলামতও প্রকাশ পাচ্ছে।

কেউ এসে বলছেন যে, হুজুর! এতদিন শুধু বউয়ের দোষ দিয়েছি, ইতেকাফে আসার ফায়দা হয়েছে এই–এখন দেখছি যে, দোষ বেশি  আমার।

কেউ এসে বলছেন যে, হুজুর! এতদিন মনে করেছি যে, এই জিনিসটা দ্বীনদারি কিন্তু এখন বুঝে গেছি  যে, ওটা তো দ্বীনদারি না , আমি তো ভুলের উপর আছি।

আবার অনেকে এসে বলেন যে, হুজুর! দ্বীনদারি এবং সমাজ, পরিবার এগুলোর সাথে এডজাস্ট  করে চলা মুশকিল হয়, এখন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এই কয়দিনের আলোচনায় বোঝা যাচ্ছে যে, এডজাস্ট করা কোন ব্যাপার না। আসলে আমরা অনেক দ্বীনদারিকে ‘দ্বীন’ মনে করে বসে আছি, এজন্য এডজাস্ট করতে পারি না।

আবার অনেকে এসে বলেন যে, আগে অনেকের সম্পর্কে অনেক বদধারণা ছিল, খারাপ ধারণা রাখতাম, এখন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ধারণাগুলো দূর হয়ে যাচ্ছে, এখন মনে হচ্ছে যে, আমিই সবচেয়ে বড় অপরাধী।

আলহামদুলিল্লাহ, এ জাতীয় প্রতিক্রিয়াগুলো এ কথার আলামত যে,  আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির প্রতি রহমতের দৃষ্টি দিচ্ছেন।  হাসান বসরী রহ. বলতেন যে, আমি শুনেছি,

من عرف ربه فقد عرف ذنبه

রবকে চেনার একটা আলামত হল, নিজের গুনাহ বুঝতে পারা।

একজন ব্যক্তি নিজের অপরাধ বুঝতে পেরেছে, এটা আলামত হল যে, সে আল্লাহত মারেফাত পাচ্ছে। আল্লাহর মারেফাতের নূর তার অন্তরের ভিতরে আসছে।

আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং অসন্তুষ্টির আলামত

ইমাম গাযালী রহ. বলতেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির একটা আলামত আছে, অসন্তুষ্টিরও একটা আলামত আছে। সন্তুষ্টির আলামত হল, যার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হন আল্লাহ তাকে নিজের দোষ দেখার ব্যাপারে চক্ষুষ্মান করে দেন। আর যে ব্যক্তির উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট আলামত হল, ওই ব্যক্তিকে আল্লাহ অন্যের দোষ দেখার ব্যাপারে চক্ষুষ্মান করে দেন।

হযরতে বায়েজীদ বোস্তামী রহ. সম্পর্কে প্রসিদ্ধ আছে, লোকজন বৃষ্টির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছে , বৃষ্টি আসছে না।  তো উনি মনে করলেন যে বৃষ্টি আসছে না আমার কারণে। কারণ আমি সবচাইতে বড় গুনাহগার। এ কথা মনে করে তিনি এলাকা থেকে বের হয়ে গেলেন। আর তখনই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।  মানুষ তো মনে করেছে বড় গুনাহগার বের হয়ে গেছে এজন্য বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আসলে তো তা নয়। আসলে তো তিনি নিজেকে গুনাহগার মনে করেছিলেন; এর কারণে আল্লাহ তাআলা রহমতের বৃষ্টি নাযিল শুরু করে দিয়েছেন।

চালুনি সুঁইকে বলে, তোর পিছনে ছিদ্র কেন?

অথচ আমাদের চরিত্র হল আমরা মনে করি, সবাই নষ্ট-আমি ভাল। সবাই খারাপ, আমি ভাল। প্রবাদ আছে, চালুনি সুঁইকে বলে,  তোর পিছনে ছিদ্র কেন; আমাদের অবস্থাও অনেকটা এরকমই। অথচ নবীজী ﷺ তো হাদিসের মধ্যে পরিষ্কার করে বলেছেন ,

إذا قالَ الرَّجُلُ: هَلَكَ النَّاسُ فَهو أهْلَكُهُمْ

যে ব্যক্তি (গর্বভরে) বলে, লোকেরা সব ধ্বংস হয়ে গেল, সে তাদের মধ্যে সর্বাধিক বেশি ধ্বংসোন্মুখ। (সহিহ মুসলিম ২৬২৩)

নাক ডাস্টবিনে কিন্তু পাছা আসমানে!

أنف في الماء إست في السماء

এটা একটি আরবী প্রবাদ। মানে নাক হল পানিতে, ডাস্টবিনে কিন্তু পাছা হল আসমানে। ঘটনা হল এই, এক ব্যক্তি টয়লেটের ভিতর পড়ে গেছে। আমি আমাদের জীবনের গল্প শুনাচ্ছি।  আমি আমার  জীবনের গল্প শুনাচ্ছি। এক ব্যক্তি টয়লেটের ভিতর পড়ে গেছে। আগের যুগের টয়লেট, সেনেটারি না। ঐ যে গাছ-টাছ দিয়ে যেগুলো বানানো হত। এখন আরেকজন তাকে তুলতে গেছে। যে বেচারা তুলতে গেছে ঐ বেচারার নাকে সর্দি। তাই  টয়লেটওয়ালা ওই ব্যক্তিকে বলে,  নাক ঝেড়ে আস। টয়লেটে যে পড়ে গেছে সে কী বলে ? বলে, আমাকে তুলতে যেয়ো না; তুমি আগে নাক পরিষ্কার করে আস।

চিন্তা করুন, সে যে কোথায় আছে এই খবর নাই। কিন্তু লোকটার নাকের ময়লাটা ঠিকই দেখছে।  তো আমাদের অবস্থা হল এই যে, আমরা যে কোথায় আছি এটা দেখি না। কিন্তু কে বাঁকা চললো, কে ত্যাড়া করে তাকালো, কে এমন করে চললো, কে এমন করে কথা বললো–এগুলো আমরা খুব দেখি!

আল্লাহর বান্দা! খুব ভাল করে বুঝুন, এটা এ কথার আলামত যে, যে ব্যক্তি এ ধরণের মানসিকতা রাখে তার উপর আল্লাহ তাআলা প্রচণ্ড রকমের অসন্তুষ্ট। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।

দুনিয়াতে থাকলে গুনাহ কিছু না কিছু হবেই

হ্যাঁ, আমরা যেহেতু দুনিয়াতে আছি, তাই আমাদের গুনাহ হয়ে  যেতে পারে। দুনিয়াতে থাকাকালীন বাতাস যখন প্রবাহিত হয় তখন  আতরের পাশ দিয়ে গেলে সুগন্ধি লাগে, ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে গেলে গন্ধ লাগে এটা কি আপনি প্রতিহত করতে পারবেন? বলতে পারবেন যে, আমি ভিআইপি মানুষ, আমার নাকে কেন গন্ধ লাগবে? বরং বাতাস তার গতিতে সুগন্ধি কিংবা দুর্গন্ধ আপনার নাকে পৌঁছাবেই।

অনুরূপভাবে আমরা যখন দুনিয়াতে আছি, এ কথা আমরা কেউই বলতে পারবো না, মরণের আগ পর্যন্তও না  যে, আমার দ্বারা গুনাহ হবে না। এটা বলতে পারবো না যে, আমার দ্বারা অহংকার হবে না।  এ কথা  বলতে পারবো না যে, আমার আমলে রিয়া আসবে না।  এ কথা বলতে পারবো না যে, আমার দ্বারা গীবত হয়ে যাবে না। আমার দ্বারা চোখের ব্যাভিচার হয়ে যাবে না। এ কথা আমরা কেউই বলতে পারব না।

আপনাদের হয়ত ধারণা যে, বড় কোন বুজুর্গ হয়তো বলতে পারবেন। ধরুন, আব্দুল কাদের জিলানী এ মাপের কোন বুজুর্গ হয়তো এ কথা বলতে পারবেন। তাহলে শুনুন, তিনিও বলতে পারবেন না। কেননা, দুনিয়া মানেই হল গুনাহর মুখোমুখি আপনাকে হতে হবে। দুনিয়া মানেই হল কখনো কখনো আমার অহংকার চলে আসবে। দুনিয়া মানেই হল কখনো কখনো আমার গীবত হয়ে যাবে, দুনিয়া মানেই হল কখনো কখনো কুদৃষ্টি আমার থেকে হয়ে যাবে। কখনো কখনো রিয়া আমার থেকে প্রকাশ পেয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমার থেকে দেখতে চান যে, এই অবস্থাতে আমার মাঝে কি গোলামীর গুণ আছে না ইবলিসের গুণ আছে!

নিজেকে গুনাহগার মনে করুন 

কথাটা বুঝাতে পেরেছি? তাহলে গুনাহ হয়ে যাওয়া এটা বড় বিষয় নয়। হ্যাঁ, এ নিয়ে  টেনশন করবেন অবশ্যই। তাহলেই তো গুনাহ থেকে বাঁচতে পারবেন। কিন্তু আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার জন্য এটা বড় বাধা নয়। বড় বাধা হল, যদি ইবলিসের আচরণ আমার আর আপনার মাঝে চলে আসে।

আল্লাহর দরবারে আমরা যদি সবসময় নিজেকে অপরাধী মনে করতে পারি, যদি মনে করতে পারি যে, আমি সবচাইতে বড় গুনাহগার, আমার চাইতে বড় গুনাহগার আর কেউ নাই, আমি মানুষের হক সবচাইতে বেশি নষ্টকারী, আল্লাহর হক নষ্টকারী, আমার সব সময় তওবা করতে হবে, আমার এই গুনাহগুলো না জানি কেমনে মাফ হবে, আহ! আমার আমল তো ইবলিস নিয়ে গেল, আহ! আমার আমল তো রিয়া শেষ করে দিল, আহ! আমার আমল তো নফস নিয়ে গেল–যদি এ ধরণের মানসিকতা লালন করতে পারি তাহলে নিজেকে এভাবে যত নিচু করতে পারব আল্লাহ আমাদেরকে তত উঁচু করতে থাকবেন। এটাকে বলা হয় বিনয়। সকল মুসলমান থেকে নিজেকে ছোট মনে করা। সবার চাইতে আমার আমল খারাপ মনে করা। সবার চাইতে আমি বড় গুনাহগার মনে করা। নবীজী ﷺ বলেন, তুমি আল্লাহর জন্য ছোট হও  رفعه  الله  আল্লাহ তোমাকে বড় করে দিবেন।

ইবলিসের আচরণ যেন চলে না আসে

আল্লাহর কাছে পানাহ চাই, কিন্তু যদি ইবলিসের স্বভাব আমার মাঝে চলে আসে অর্থাৎ যদি এভাবে চিন্তা করি যে, আমি তো এই নেক কাজটা করি, অমুক তো মদখোর, অমুক তো এই কাজটা করে না, অমুক তো এত বড় গুনাহগার… তাহলে শুনুন, খুব ভাল করে শুনুন, আপনি আর আমি ঈমান নিয়ে মারা যাবো ‘আল্লাহর কাছে পানাহ চাই, আল্লাহ সকল বেঈমানি থেকে আমাদের সকলকে হেফাজত করুন , সকল নেফাকি থেকে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখুন’ কিন্তু আমি আর আপনি ঈমান নিয়ে মারা যাবো,  এর নিশ্চয়তাটা কোথায় আছে? কে এই নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে, সে ঈমান নিয়ে মারা যাবে?  এ নিশ্চয়তা আমরা কেউই দিতে পারব না। একান্ত আল্লাহর রহমত ছাড়া  এ নিশ্চয়তা আমরা কেউই দিতে পারবো না। আল্লাহ তাআলা আমাদের ঈমানের দৌলত নসীব করুন। আমিন।

আবু দারদা রাযি.-এর মৃত্যুকালীন ঘটনা

আরে আমরা কী?  সাহাবায়ে কেরাম, যাদের ঈমান গঠন করেছেন স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সাহাবী হযরত আবু দারদা রাযি.। যখন তাঁর মৃত্যু হচ্ছিল, তার স্ত্রী উম্মে দারদা রাযি.তাঁর পাশে বসে আফসোস করছিলেন আর কান্না করছিলেন। আবু দারদা রাযি. তখন স্ত্রীকে বললেন, উম্মে দারদা! এখানে বসে কান্নার দরকার নাই  আমি আমার হাবীব থেকে হাদিস শুনেছি , আল্লাহ তাআলার দুই হাত। এক হাতের মধ্যে আল্লাহ ইমানদারদের রুহগুলো রেখেছেন। আরেক হাতের মধ্যে আল্লাহ বেঈমানদের রুহগুলো রেখেছেন। আমি আবু দারদার তো জানা নাই, আমার রুহটা আল্লাহর কোন হাতের ভিতর আছে? বাম হাতের  ভিতরে না ডান হাতের ভিতরে আছে? আমার তো এটা জানা নাই। সুতরাং উম্মে দারদা! তুমি জায়নামাজ নিয়ে বস, আল্লাহর কাছে দোয়া কর, আল্লাহ যেন আমাকে ঈমানের হালতে মওত দান করেন।

চিন্তা করে দেখুন,  আবু দারদা রাযি. ছিলেন حكيم هذه الامة  এই উম্মতের হাকিম, শীর্ষ সাহাবীদের একজন ছিলেন তিনি। আলেম সাহাবী ছিলেন। আর তিনি একথা বলছেন!

উম্মে দারদা রাযি. জায়নামাজ নিয়ে বসে গেলেন। আল্লাহর কাছে দোয়া শুরু করে দিলেন এই মহান সাহাবীর জন্য।

ও আল্লাহর বান্দা! সেখানে আমি আর আপনি কে? আমরা কেন এ কথা দেখি না যে, আল্লাহ ইবলিসের এক হাজারের বছরের ইবাদতের ব্যাপারে বলেছেন, দরকার নাই। এক হাজার বছরের ইবাদত আর আল্লাহ এক সেকেন্ডে বলে দিলেন, দরকার নাই।বালআ’ম বাউ’রার তিনশ’ বছরের ইবাদত আল্লাহ এক সেকেন্ডে বলে দিলেন, দরকার নাই।

অপর দিকে যে লোকটি একশ লোক হত্যা করেছে আল্লাহ তাকে মাফ করে জান্নাতে ডেকে নিলেন।

এর কারণ হল, আল্লাহ তাআলা আমলগুলো পরে দেখেন। আল্লাহ আগে দেখেন দিলের অবস্থা। ইবাদত করে ভরপুর করে দিলাম কিন্তু দিল ইবলিস মার্কা। কোন লাভ নাই। কোন ফায়দা নাই। দিল হল এমন যে, মনে করছি আমি সবচাইতে ভাল, আর সবাই খারাপ। আমারটাই ঠিক, বাকি সবগুলো বেঠিক। আমি যে কাজ করি এটাই দ্বীন, বাকি কোনটাই দ্বীন না। তাহলে কোন লাভ নাই! কেননা, এতো ইবলিসের মানসিকতা। সে বলেছিল, আমিই শ্রেষ্ঠ  انا خير منه  আমি আদমের চাইতে শ্রেষ্ঠ।

যাই হোক, উম্মে দারদা রাযি. আল্লাহর কাছে দোয়া শুরু করে দিলেন যে, ওগো আল্লাহ! আপনি আমার স্বামী আবু দারদাকে ঈমানের হালতে মউত দান করেন। কিছুক্ষণ পর আবু দারদা রাযি.-এর ইন্তেকাল হল। আলহামদুলিল্লাহ, ঈমানের সাথে ইন্তেকাল হয়েছে। ঘোষক ঘোষণা দিল, উম্মে দারদা! ওঠো,  আল্লাহর কাছে আর কান্নাকাটির দরকার নাই, কারণ তোমার স্বামী আবু দারদার ঈমানের সাথে মউত হয়েছে।

এক মদখোরের ঘটনা

এজন্য বড়াই  করতে নেই, অহংকার করতে নাই। বরং সবসময় এ কথা মনে রাখতে হয়, যে আমার চাইতে বদ আমলওয়ালা আমার চাইতে খারাপ মানুষ আর কেউ নাই। সহিহ বুখারির হাদিসে এসেছে, এক লোক মদপান করেছিল, একবার, দুইবার, তিনবার। নবীজী ﷺ প্রত্যেকবার এনে তাকে শাস্তি দিলেন। তৃতীয়বার যখন ঘটল তখন এক সাহাবী তাকে লানত করে বসলেন। নবিজী ﷺ তখন ওই সাহাবীকে সতর্ক করে বললেন,

لا تَلْعَنُوهُ، فَوَاللَّهِ ما عَلِمْتُ إنَّه يُحِبُّ اللَّهَ ورَسولَهُ

খবরদার ! তোমরা একে গালি দিয়ো না। কারণ সে আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালোবাসে। (সহিহ বুখারী ২৬২৩)

এ হাদিস থেকেও বোঝা যায়, যতবড় গুনাহগার হোক তাকে ঘৃণার কিচ্ছু নাই। যতক্ষণ তার মাঝে কুফুরী পাওয়া যাবে না। কারণ, হতে পারে এ লোকটা আমার চাইতে বড় তওবাকারী হয়ে যাবে। আর এও হতে পারে যে, এ লোকটার এমন কোন আমল তার অন্তরে আছে যে আমলটা আল্লাহ তাআলা খুব পছন্দ করেন ।

আবু জর গিফারি রাযি.-এর ঘটনা

সাহাবী আবু জর গিফারি রাযি. চাদর মুড়ি দিয়ে মসজিদের কর্নারে বসা। জিবরাইল ﷺ -এর কাছে এসে বললেন, মসজিদের কর্নারে চাদর মুড়ি দিয়ে যে লোকটা বসে আছে এ লোকটাকে আপনারা যতটা চিনেন  আমরা আকাশের ফিরিশতারা আরো বেশি চিনি। কারণ, তাঁর কথা আমাদের মাঝে আলোচনা হয় । নবীজী ﷺ বললেন, কেন? জিবরাইল আলাইহিস সালাম বললেন, তাঁর মাঝে দুইটি বৈশিষ্ট্য আছে। এক. তিনি নিজেকে সবচেয়ে ছোট মনে করেন। দুই.  তিনি বেশি বেশি  قُلْ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ পড়েন। (তাফসীরে কাবীর ৩০/১৬০)

হাদিসের মাঝে এসেছে, যে ব্যক্তি দশবার  قُلْ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ পড়বে আল্লাহ জান্নাতে তাঁর জন্য একটি বাড়ি তৈরি করে দিবেন । (মাজমাউ’যযাওয়াইয়িদ ৭/১৪৫)

সুতরাং নিজেকে ছোট মনে করা  এ কথার আলামত যে, আল্লাহ আমাকে দয়া করতে চাচ্ছেন। আর আমিও রেডি আছি দয়া নেওয়ার জন্য। আল্লাহর একটা বৈশিষ্ট্য হল, আল্লাহ মুতাকাব্বির। মুতাকাব্বির মানে প্রচণ্ড অহংকারী । হাদিস শরিফে এসেছে, অহংকার হল আল্লাহর চাদর, যে অহংকার করল সে আল্লাহ্‌র চাদর নিয়ে টানাটানি করল।

গুনাহর সঙ্গে আমাদের আচরণবিধি কেমন হওয়া চাই

নিজের গুনাহর দিকে তাকিয়ে নিজেকে ছোট মনে করার এই মানসিকতা আপনাকে বহু গুনাহ থেকে রক্ষা করবে। হ্যাঁ, এর পরেও মাঝে মাঝে গুনাহ হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে অহংকার চলে আসবে, গীবত হয়ে  যাবে, হিংসা হয়ে যাবে। হয়ত কিছু হারামও ঢুকে যেতে পারে। কিংবা হঠাৎ মোবাইলে একটা গুনাহ হয়ে যেতে পার। ফেসবুকে একটা গুনাহ হয়ে যেতে পারে। তখন আপনি কী করবেন?  গুনাহটার সাথে তখন আপনার আচরণ কেমন হবে?

প্রথমত চেষ্টা করতে হবে যেন গুনাহ না হয়

প্রথমত চেষ্টা করতে হবে যেন আমার দ্বারা গুনাহ না হয়। তাওবা করলে গুনাহ মাফ হয় এ কথা নিশ্চিত। কিন্তু গুনাহের একটা তাসির আছে। আর তাহল, গুনাহ গুনাহকে টানে। তাওবা করলে গুনাহ মাফ হয়ে গেলেও এর তাসির থাকে। তাই সতর্কতা হল, সেফ জোনে (Safe Zone) থাকা। আর এটাই হল  মূল। এটার চাইতে বড় আমল আর কোন  কিছু নাই।

নবীজী ﷺ বলেন,

اتَّقِ المَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ

গুনাহ থেকে বেঁচে থাক সবচেয়ে বড় আল্লাহ্‌র অলি হতে পারবে। (তিরমযী ২৩০৫)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি.-কে যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, এক ব্যক্তির ইবাদত কম, গুনাহও কম। আরেক ব্যক্তির ইবাদতও বেশি গুনাহও বেশি। এই দুই ব্যক্তির মাঝে উত্তম কে? তিনি উত্তর দিলেন,

لَا أَعْدِلُ بِالسَّلَامَةِ شَيْئًا

গুনাহ থেকে নিরাপদ থাকার মত সমকক্ষ আমল আমি কোনোটিকে মনে করি না। (আদাবুদদুনয়া ওয়াদদীন ১/৯৮)

এরপরেও গুনাহ হয়ে যেতে পারে

এরপরেও আমাদের গুনাহ হয়ে যেতে পারে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন,

لو لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللَّهُ بِكُمْ، وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ، فَيَسْتَغْفِرُونَ اللَّهَ فَيَغْفِرُ لهمْ

যদি তোমরা গুনাহ না কর তবে আমি তোমাদের ধ্বংস করে দিয়ে আরেকটা জাতি তৈরি করব যারা গুনাহ করবে তারপর তারা আল্লাহর কাছে ইসতেগফার করবে এবং তিনি তাদের মাফ করে দিবেন। (সহিহ মুসলিম ২৭৪৯)

এর অর্থ কি গুনাহ করবো? না। বরং এর অর্থ হল, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার শতভাগ চেষ্টা করলেও গুনাহ হয়ে যাবে। কারণ আমরা আছি দুনিয়াতে। আপনি যদি এসি রুমে থাকেন তবুও কাপড় ময়লা হয়। বাইরে থাকলে বেশি হয়। আপনি গুনাহ থেকে বেঁচে  থাকেন এর অর্থ হল আপনি এসি রুমে আছেন। ময়লা কম হবে কিন্তু হবে।  আমাদের মূল কাজ হল, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।

মনে গুনাহর চিন্তা আসার পরেও গুনাহ না করার ফজিলত

তাহলে প্রশ্ন হল, এরপরেও যদি গুনাহ হয়ে যায় তাহলে আমরা কী করব? গুনাহর সঙ্গে আমাদের আদব বা আচরণবিধি কেমন হবে?

এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা হল, গুনাহ হওয়ার দুইটা স্তর। একটা হল মনে গুনাহর চিন্তা আসা। যেমন আমি চিন্তা করলাম যে, এ কয়দিনে তো বহু সিরিয়াল মিস হয়ে গেছে, ইতিকাফ শেষ হওয়ার পরে সিরিয়াল দেখতে হবে। ইতিকাফে ছিলাম গার্লফ্রেন্ডের সাথে তো কথা বলি নাই  ইতিকাফ শেষে কথা বলতে হবে। গুনাহটা যদি এভাবে মনে মনে থাকে তবে বের না হওয়া পর্যন্ত মাফ। আল্লাহ ফেরেশতাকেও মনের এ খবর জানতে দিবেন না। বরং যদি গুনাহটা মনে আসার পরেও না করেন তবে আল্লাহ তাআলা তাঁর ফেরশতাকে ইনফর্ম করবেন যে, আমার এ বান্দার মনে গুনাহর চিন্তা এসেছিল কিন্তু করে নাই , সুতরাং তার আমলনামায় নেকি লেখ। নবীজী ﷺ বলেন,

ومَن هَمَّ بسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْها، كَتَبَها اللَّهُ له عِنْدَهُ حَسَنَةً كامِلَةً

যে কোন গুনাহর ইচ্ছা করে আর তা না করে, তাহলে আল্লাহ্ তার জন্য পরিপূর্ণ নেকী লিখে দেন। (সহীহ বুখারী ৬৪৯১)

তাহলে এটা হল একটা পর্যায় যে, গুনাহটা মনে আসা। ইচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।

মুয়াবিয়া রাযি.-এর ঘটনা

আরেকটা পর্যায় হল গুনাহটা মন থেকে বাইরে বের হয়ে আসা অর্থাৎ গুনাহ পরিপূর্ণভাবে অস্তিত্বে চলে আসা। তখন গুনাহের সাথে এমন কিছু আচরণ করতে হয় যেন গুনাহটা দ্বিতীয়বার আসার ব্যাপারে ভয় পেয়ে যায়।

মুয়াবিয়া রাযি.-এর একদিন তাহাজ্জুদ ছুটে গিয়েছিল। তাই পরের দিন আল্লাহ্‌র কাছে এমন কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন যে, তাহাজ্জুদ পড়লে যে ফযিলত পেতেন, আল্লাহ তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ফযিলত দিয়ে দিলেন। পরের দিন তাহাজ্জুদের সময় ইবলিস এসে তাঁকে ঘুম থেকে জাগাচ্ছিল। তিনি ইবলিসের হাত ধরে ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি? সে বলল, আগে ছাড়েন, ছাড়লে কিছু ইলম শিখাব। তিনি ছেড়ে  দিলেন। এবার ইবলিস বলল, আমি ইবলিস। একদিন আপনাকে তাহাজ্জুদে ধোঁকা দিয়ে মিস করিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি এমন কান্নাকাটি করলেন আল্লাহ আপনাকে তাহাজ্জুদের চেয়ে অনেক বেশি সওয়াব দিয়ে দিয়েছেন। তাই ভেবে দেখলাম, লস প্রজেক্টে হাত দিয়েছি। ভাবলাম, আপনি তাহাজ্জুদ পড়েন এটাই বরং ভাল।

এটা ছিল সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে। আর আমাদের অবস্থা তো  হল, ইবলিস যখনই আসে সিট খালি পায়!

ইবলিসকে মানসিকভাবে কষ্ট দিন

একটা চুটকি বলি। আমাদের এলাকায় একটা কুকুর প্রতিদিন মসজিদের সামনে এসে ময়লা করত। একদিন আমার এক উস্তাদ সম্পর্কে আমার ফুফাও হন কুকুরটাকে বেঁধে ভাল করে পিটালেন। এরপর থেকে ফুফাকে ১০০ গজ দূর থেকে দেখলেও সে ভয়ে দৌড়ে পালাত। এবার চিন্তা করে দেখুন, উমর রাযি. কী পরিমাণ মানসিক শাস্তি ইবলিসকে  দিলে উমর রাযি. এক পথ ধরলে ইবলিস অন্য পথ ধরত।  তাই আমাদের কাজ হল ইবলিসকে মানসিক নির্যাতন করা।

হাসান বসরি রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হল, ইবলিসকে কষ্ট দেওয়ার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী আমল কোনটা? তিনি বললেন, ইবলিসকে কষ্ট দেওয়ার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী আমল হল তাওবা।

আদাবুযযুনুব তথা গুনাহর সঙ্গে আচরণবিধি ০৬ টি

এক. তাওবা করা

সুতরাং গুনাহর ব্যাপারে আমাদের প্রথম আচরণ হবে তাওবা। এভাবে গুনাহের সাথে আমরা সর্বমোট ০৬ টি আচরণ দেখাব। এগুলোকে বলা হয়, আদাবুযযুনুব। এই আচরণগুলো করলে ইবলিস মানসিকভাবে প্রচণ্ড কষ্ট পাবে। সে কিছুটা হলেও ভয় পাবে। সে তখন দেখবে যে, লাভ কম। তখন সে ওখানেই যাবে যেখানে লাভ বেশি। আমাদের কাছে আসা সে কমিয়ে দিবে।

হাফেজ ইবনু তাইমিয়া রহ. লিখেছেন, এক ব্যক্তি তাঁর শায়েখকে বলল, আমার গুনাহ হয়ে যায় কী করব? শায়েখ বললেন, তাওবা করবে। লোকটি বলল, তাওবা করার পর যদি আবার গুনাহ হয়? শায়েখ বললেন, তাওবা করবে। লোকটি বলল, যদি আবারও গুনাহ হয়? শায়েখ বললেন, এবারও তাওবা করবে। লোকটি বলল, কত বার তাওবা করব? শায়েখ উত্তর দিলেন, إلى أن تُحْزِنَ الشيطان শয়তানকে পেরেশান করা পর্যন্ত তাওবা করতেই থাকবে।

আব্দুল কাদের জিলানী রহ-এর ঘটনা 

এরপরেও আমরা নিরাশ হতে পারি কিন্তু ইবলিস নিরাশ হবে না। একজন লোক যত বড় আল্লাহ্‌র অলি হোক এরপরেও সে তাঁর ব্যাপারে আশা করে যে, কোনভাবে তাঁকে গোমরাহ করা যায় কিনা?

আব্দুল কাদের জিলানী রহ. তাহাজ্জুদ পড়ছিলেন। আকাশ থেকে আলো আসল। গায়েব থেকে আওয়াজ আসল, আপনি তো জান্নাতে চলে গেছেন। আপনার আর কোন  ইবাদতের দরকার নাই। আব্দুল কাদের জিলানী রহ. বললেন, ইবলিস! দূর হও। ভাগো এখান থেকে। কে বলেছে আমার ইবাদতের দরকার নাই! নবীদের পর্যন্ত ইবাদতের দরকার হয়েছে, সেখানে আমি কে? সাহাবায়ে কেরামের ইবাদতের দরকার হয়েছে সেখানে আমি কে?

সুতরাং ইবলিস আপনাকে আমাকে কিভাবে ধোঁকা দিবে বলা যায় না। তবে চেষ্টা করতে হবে তার আসা যাওয়াটা  যেন কমে যায় এবং  সে  যেন আমার আপনার থেকে নিরাশ হয়ে যায়। আর এ লক্ষে প্রথম কাজ হল তাওবা করা।

তাওবার সংক্ষিপ্ত ফজিলত

নবীজী ﷺ বলেছেন,

كلُّ ابنِ آدمَ خطَّاءٌ ، وخيرُ الخطَّائينَ التَّوَّابونَ

সকল আদম সন্তান ভুলকারী। আর ভুলকারীদের মধ্যে সেরা তারাই, যারা তওবাকারী। (তিরমযী ২৪৯৯)

বোঝা গেল, অনিচ্ছাকৃতভাবে গুনাহ হওয়াটা ভুল তবে বড় ভুল নয়। বড় ভুল হল, তাওবা না করা।

অপর হাদিসে নবীজী ﷺ বলেছেন,

لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ

কোন বান্দা তাওবা করলে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন। (মুসলিম ২৭৪৭)

আরো পড়ুন আদাবুযযুনূব পর্ব ০২