রাফয়ে’ ইয়াদাইন এবং জোরে আমীন বলা প্রসঙ্গে

জিজ্ঞাসা–৫৪৪: আসসালামু আ’লাইকুম। হুজুর প্রায় কিছু ভাই রাফাদাঈন এবং জোরে আমিন নিয়ে বলে যে, হাদীস আনুযায়ী এই আমল করা যায় এবং এই ব্যপারে কেউ কিছু বললে মনে কষ্ট পায়। এখন কথা হচ্ছে যে, আমল করা যাবে কি যাবে না? তা হাদীস ও মাযহাব সমুহের অনুযায়ী বিস্তারিত জানালে ভালো হতে। এখানে মাযহাব এর কথা বলার কারণ হল কেউ কেউ অন্য মাযহাব এর কথা বলে থাকে আমল করার ব্যপারে।–মুহাম্মদ আলী হায়দার।

জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

এক- প্রিয় দীনি ভাই, ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেছেন, ‘রাফয়ে’ ইয়াদাইন করা না করা কিংবা জোরে আমীন বলা না বলা এটা ইখতিলাফে মুবাহর অন্তর্ভুক্ত, যেখানে কোনো পক্ষেরই নিন্দা করা যায় না। যে রাফয়ে’ ইয়াদাইন করছে, জোরে আমীন বলছে; তারও না। যে রাফয়ে’ ইয়াদাইন করছে না, জোরে আমীন বলছে না; তারও না।

وهذا من الاختلاف المباح الذي لا يعنف فيه من فعله ولا من تركه وهذا كرفع اليدين في الصلاة وتركه

(যাদুল মাআদ ১/৭০, মিসর ১৩৬৯ হি., কুনূত প্রসঙ্গ)

ইবনুল কাইয়্যিম রহ.-এর বক্তব্য থেকে জানা যায়, এ বিষয়ে সবাই একমত যে, রাফয়ে’ ইয়াদাইন করা না করা কিংবা আমীন আস্তে ও জোরে দু’ ভাবেই আছে। স্ব স্ব স্থানে উভয় মতই শরীয়ত স্বীকৃত। এটা মূলত ‘তানাওউয়ে সুন্নাহ’ বা সুন্নাহর বিভিন্নতা, যাকে ইখতিলাফে মুবাহও বলা হয় অর্থাৎ এখানে দুটি নিয়মই মোবাহ ও বৈধ। কেননা দু’টোরই উৎস সুন্নাহ। সুতরাং যে নিয়মই অনুসরণ করা হোক সুন্নত আদায় হবে। তবে বিভিন্ন আলামতের ভিত্তিতে ইজতিহাদের আলোকে কোনো ফকীহ কোনো একটিকে উত্তম ও অগ্রগণ্য মনে করেন। আর অন্যটিকেও বৈধ তবে অনুত্তম মনে করেন। আবার অন্য ফকীহ এর বিপরীত মত পোষণ করেন। চার মাযহাবের ক্ষেত্রে এই পার্থক্যটুকু শুধু সুন্নাহ আদায়ের উত্তম ও অনুত্তম পদ্ধতি নিয়ে।

অর্থ্যাৎ চার মাযহাবই এ বিষয়ে একমত যে, রাফয়ে’ ইয়াদাইন করা হোক বা না হোক; জোরে আমীন বলা হোক কিংবা আস্তে বলা হোক; এতে নামাযের কোনো ক্ষতি হবে না।

দুই- ফিক্বহে হানাফী মতে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া বাকি সময় হাত উঠানো এবং সূরা ফাতিহার পর জোরে আমীন বলা উত্তম নয়। এ বক্তব্যটিও সহীহ হাদীস এবং সাহাবাদের ফাতওয়া এবং বিজ্ঞ ব্যক্তিদের আমলের সূত্র পরম্পরায় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাই এটি আমাদের নিকট উত্তম। উত্তরের দীর্ঘায়িতা এড়ানোর লক্ষে আমরা এখানে দুটির ক্ষেত্রে দুটি দলিল পেশ করছি।  অন্যথায় ‘আলহামদুলিল্লাহ’ আরও বহু দলিল আছে। বিস্তারিত জানার জন্য পড়তে পারেন ড. শাইখ মুহাম্মদ ইলিয়াস ফয়সাল (মদিনা মুনাওয়ারা) কতৃক সংকলিত, মাকতাবাতুল আশরাফ ঢাকা থেকে অনুবাদকৃত ও প্রকাশিত ‘নবীজীর নামায’ অথবা মাওলানা আব্দুল মতিন কতৃক সংকলিত,মাকতাবাতুল আযহার ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দলিলসহ নামাযের মাসায়েল’।

রাফয়ে ইয়াদাইন না করার দলিল

عَنْ عَلْقَمَةَ قَالَ قَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مَسْعُودٍ أَلاَ أُصَلِّى بِكُمْ صَلاَةَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ قَالَ فَصَلَّى فَلَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ إِلاَّ مَرَّة

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন আমি কি তোমাদেরকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নামায সম্পর্কে অবহিত করব না? এ কথা বলে তিনি নামায পড়ে দেখালেন এবং নামাযে তাকবীরে তাহরীমার সময় একবার রাফয়ে’ ইয়াদাইন করলেন। নামাযে আর কোথাও তিনি রাফয়ে’ ইয়াদাইন করলেন না। (আবু দাউদ ৭৪৮, তিরমিযী ২৫৭, সুনানে দারেমী ১৩০৪, সুনানে নাসায়ী ৬৪৫, সুনানে বায়হাকী কুবরা  মুসনাদে আহমাদ ৩৬৮১)

আস্তে আমীন বলার দলিল

ওয়াইল ইবন হুজর রাযি. ইয়ামানবাসী সাহাবি ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর দরবারে দীন শিক্ষা করার জন্যই এসেছিলেন। তিনি ২০ দিন রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর সোহবতে ছিলেন এবং ৬০ ওয়াক্ত জোরে কিরআতবিশিষ্ট নামায পড়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের ঠিক পিছনে তার জন্য জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। ওয়াইল ইবন হুজর রাযি. বলেন, এই ৬০ ওয়াক্ত নামাযের মধ্যে মাত্র তিন ওয়াক্ত নামাযে রাসূলুল্লাহ ﷺ জোরে আমীন বলেছিলেন ( আর ৫৭ ওয়াক্ত নামাযে আমীন আস্তে বলেছিলেন)। আমার বুঝতে বাকি ছিল না যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই এমনটি করেছিলেন। (আল আসমাউ ওয়ালকুনা ১/১৯৭ মাজমাউজ যাওয়াইদ ২/১১৩ নাসাঈ ৯৩২, শরহুল মাওয়াহিব ৭/১১৩ শরহে বুখারী দূলাবী প্রণীত)।

তিন- যেসব ক্ষেত্রে একাধিক সুন্নাহ আছে, যেহেতু দু’টোই শরীয়তে স্বীকৃত তাই যে অঞ্চলে যে সুন্নাহ প্রচলিত সেখানে সেটিই চলতে দেওয়া উচিত। প্রচলিত সুন্নাহকে প্রত্যাখ্যান করে তার স্থলে ভিন্ন সুন্নাহ জারি করার প্রচেষ্টা যেমন শরীয়তের নীতি ও মিযাজের পরিপন্থী তেমনি মুসলমানদের ঐক্য ও শৃঙ্খলার পক্ষেও ক্ষতিকর। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ তো হয় বিদআতের ক্ষেত্রে, সুন্নাহর ক্ষেত্রে নয়।

এ প্রসঙ্গে ইসমাঈল শহীদ রহ.-এর ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। তিনি একবার রুকু ইত্যাদিতে ‘রাফয়ে ইয়াদাইন’ করতে আরম্ভ করেছিলেন। অথচ সে সময় গোটা ভারতবর্ষের সর্বত্র (ক্ষুদ্র কিছু অঞ্চল ব্যতিক্রম ছিল, যেখানে ফিকহে শাফেয়ী অনুযায়ী আমল হত) নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোনো স্থানে রাফয়ে ইয়াদাইন না-করার সুন্নতটি প্রচলিত ছিল। শাহ শহীদ রহ.-এর বক্তব্য এই ছিল যে, মৃত সুন্নত জীবিত করার ছওয়াব অনেক বেশি। হাদীস শরীফে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে- من تمسك بسنتي عند فساد أمتي فله أجر مئة شهيد ‘উম্মতের ফাসাদের মুহূর্তে যে আমার সুন্নাহকে ধারণ করে সে একশত শহীদের মর্যাদা পাবে।’

তখন তাঁর চাচা হযরত মাওলানা আবদুল কাদের দেহলবী রাহ. (শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ.-এর পুত্র, তাফসীরে মূযিহুল কুরআন-এর রচয়িতা) তার এই ধারণা সংশোধন করে দেন। তিনি বলেন, ‘‘মৃত সুন্নাহকে জীবিত করার ফযীলত যে হাদীসে এসেছে সেখানে বলা হয়েছে যে, উম্মাহর ফাসাদের যুগে যে ব্যক্তি সুন্নাহকে ধারণ করে তার জন্য এই ফযীলত। আর একথা বলাই বাহুল্য যে, কোনো বিষয়ে যদি দু’টো পদ্ধতি থাকে এবং দু’টোই মাসনূন (সুন্নাহভিত্তিক) হয় তাহলে এদের কোনো একটিকেও ‘ফাসাদ’ বলা যায় না। সুন্নাহর বিপরীতে শিরক ও বিদআত হল ফাসাদ,কিন্তু দ্বিতীয় সুন্নাহ কখনও ফাসাদ নয়। কেননা, দু’টোই সুন্নাহ। অতএব রাফয়ে ইয়াদাইন না-করাও যখন সুন্নাহ, তো কোথাও এ সুন্নাহ অনুযায়ী আমল হতে থাকলে সেখানে রাফয়ে ইয়াদাইনের সুন্নাহ ‘জীবিত’ করে উপরোক্ত ছওয়াবের আশা করা ভুল। এটা ওই হাদীসের ভুল প্রয়োগ। কেননা এতে পরোক্ষভাবে দ্বিতীয় সুন্নাহকে ফাসাদ বলা হয়, যা কোনো মতেই সঠিক নয়।’(মালফূযাতে হাকীমুল উম্মত  ১/৫৪০-৫৪১, মালফুয :১১১২ )

সালাফের উক্ত নীতির কারণেই ওলামায়ে কেরাম এসব অঞ্চলে অন্য কোনো পন্থা প্রচার করার প্রয়োজন বোধ করেন নি। কিন্তু কিছু অপরিণামদর্শী মানুষ, তারা এই সূক্ষ্ম বিষয়টা অনুধাবন করতে পারেন নি। তাই তারা এক মাসনূন তরীকাকে অন্য মাসনূন তরীকার দ্বারা, এক মুবাহ তরীকাকে অন্য মুবাহ তরীকার দ্বারা এবং এক মুজতাহাদ ফীহ মতকে অন্য মুজতাহাদ ফীহ মতের  দ্বারা খন্ডন করার মধ্যে ছওয়াব অন্বেষণ করেছেন। তদ্রূপ অন্য মতটিকে (যার ভিত্তিও  দলীলের উপর) বাতিল বলে দেওয়াকে ছওয়াবের কাজ বলে মনে করেছেন। ফলে বিবাদ-বিসংবাদের সূত্রপাত হয়েছে যা নিশ্চিতভাবে হারাম। আর ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে, যার বিষফল আজও মুসলমানদেরকে ভুগতে হচ্ছে। অথচ আমরা এ থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করি নি।

আমরা আল্লাহর কাছে তাদের জন্য দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাদেরকে সঠিক বুঝ দান করেন।

الله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
আরো পড়ুন-
তাশাহ্হুদে শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা
তারাবীর নামাযের রাকাত সংখ্যা কত?
নিম্নস্বরের কিরাত-বিশিষ্ট নামাজে ইমামের পিছনে কিরাত পড়তে হবে?
নামাজে নাভীর নিচে হাত বাঁধার দলিল কি?
মহিলারা সবখানে যেতে পারলে মসজিদে কেন পারবে না?
ইমামের পিছনে কেরাত পড়লে নামাজ হবে কিনা?
সিজদায় কনুই বিছিয়ে দেয়া নিষেধ কার জন্য?
খুতবা মাতৃভাষায় দেওয়া যাবে কি?

১ টি মন্তব্য

  1. Dear Omair Kobbati Bhai,
    Assalamualaikum wa rahmatullah
    Many thanks for your writing regarding “Rafae Yadain” which is really informative.
    The writing could have been more enriched if you had also mentioned the hadiths in favour of Rafae Yadain. You only mentioned the hadith not in favour of it.
    Jazakallahu Khairan
    Shibly from Monipur

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

8 − eight =