তিন. ইন্টারনেটের অপব্যবহার
মুহতারাম উপস্থিতি, আজ আমাদের নিয়ন্ত্রক আমরা নই। আমরা আজ মনস্তাত্বিকভাবে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের হাতে বন্দি। আমাদের যুবকদের হাতে তারা স্মার্ট ফোন তুলে দিয়েছে। আমাদের শায়খের ভাষায়, ‘এটা সেল ফোন নয়; হেল ফোন (hell phone)। hell অর্থ জাহান্নাম। এটা ইন্টারনেট নয়; enter net মানে জালে প্রবেশ করানো। এটা চ্যাটিং নয়; চিটিং (cheating) বা প্রতারণা।’ আমি এগুলোর সঠিক ব্যবহারের সমালোচনা করছি না। আর না এগুলোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি। তবে আমি বুঝাতে চাচ্ছি, এগুলোর অপব্যবহারের ভয়াবহতা। যুবকরা আজ রাত কাটায় এসবের সঙ্গে। কখন যে রাত কেটে যায়, টেরই পায় না। ফেসবুক নিয়ে বসে, ম্যাসেঞ্জারে পরনারীর সঙ্গে চ্যাট করে, চিন্তা করে, একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ব, এই আর অল্প কিছুক্ষণ…কিন্তু পারে না। এভাবে কখন যে রাত পলপল করে শেষ হয়ে যায়…১০ টা থেকে ১১ টা, ১১ টা থেকে ১২ টা ০১ টা ০২ টা ০৩ টা… তারপর ফজরের আযানের ডাক শুনে ঘুম থেকে উঠে না; বরং আযানের ডাক শুনে ঘুমাতে যায়। কিন্তু ঈমানদার তো, তাই মাঝে মাঝে মন খচখচও করে। কিন্তু কী করবে! পারে না। কারণ, হাতে যে শেকল। সে যে এই শিকলে বন্দী হয়ে আছে। আর এই শিকলের নাম হল, ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন। আর এটাই তারুণ্যকে, যুবসমাজকে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই, এমনও শুনেছি, এখনকার যুবক-যুবতীরা নাকি এখন ইমো, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদির মাধ্যমেও সেক্স করে, ব্যভিচার করে!
অভিবাকদের বলছি…
এজন্য অভিবাকদের উদ্দেশ্য বলছি। আপনার সন্তান কী করে, তা একটু তদারকি করবেন। মাঝে মাঝে তার দরজার নীচে দেখবেন, গভীর রাতে তার রুম থেকে কম্পিউটারের স্ক্রিনের আলো আসে কিনা! ল্যাপটপ, মোবাইল এসবের পেছনে মাত্রারিক্ত সময় দেয় কিনা? প্রয়োজনে স্মার্ট ফোন কিনে দিতে বললে শর্ত জুড়ে দিবেন যে, ঠিক আছে, কিনে দিব তবে সেটে পাসওয়ার্ড দিতে পারবা না। তাকে বলবেন, আমি মাঝে মধ্যে তোমার সেটে কী আছে- দেখব। মনে রাখবেন, এটা গোয়েন্দাগিরি নয়। বরং এটা তরবিয়তেরই অংশ। আপনি এমনটি করবেন, আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য, তার জীবন পবিত্র হিসেবে তৈরি করার জন্য।
এ রোগের চিকিৎসা
মুহতারাম উপস্থিতি, যারা ইন্টারনেটে আসক্ত। গান, সিনেমা, সিরিয়াল ও এজাতীয় নোংরা বিষয়ের নেশায় নেশাগ্রস্থ, তাদের জন্য চিকিৎসা কী হতে পারে- আমাদের মাশায়েখগণ তাও বলে দিয়েছেন। তাছাড়া ইতিপূর্বে আমরা দুই রোগের জন্য যে ছয়টি চিকিৎসার কথা শুনেছি, সেগুলোও এখানে প্রযোজ্য। তবুও এ রোগের জন্য আরো তিনটি ব্যবস্থাপত্র দিয়ে দিচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সকলকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
১. মাঝে মাঝে জ্বলন্ত আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাববেন…
মাঝে মাঝে গ্যাসের চুলার সামনে দাঁড়াবেন। আগুন দেখবেন। আল্লাহ বলেছেন, أَفَرَأَيْتُمُ النَّارَ الَّتِي تُورُونَ ‘তোমরা যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি?’ (সূরা ওয়াকিয়া ৭১)
সুতরাং আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাববেন, এই দুনিয়ার আগুনের ইন্ধন তো লাকড়ি, গ্যাস ইত্যাদি। এর উত্তাপ যদি এত বেশি হয় যে, আমি এক মিনিটও সইতে পারব না। তাহলে এই গোপন গুনাহর কারণে আমি যে নিজেকে ওই জাহান্নামের উপযুক্ত করে নিচ্ছি, وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُযে আগুনের ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, সেই আগুন আমি সৈহ্য করব কিভাবে! এভাবে চিন্তা করলে গোপন গুনাহর ভূত ধীরে ধীরে নেমে যাবে, ইনশা আল্লাহ।
২.মাঝে মাঝে কবর জেয়ারত করবেন
মাঝে মাঝে কবর জেয়ারত করবেন। এর দ্বারা দিল নরম হবে। গুনাহর প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। আমলের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
فَإِنَّهَا تُرِقُّ الْقَلْبَ ، وَتُدْمِعُ الْعَيْنَ ، وَتُذَكِّرُ الآخِرَةَ
কবর জিয়ারত অন্তরকে নরম করে, চোখের পানি বের করে এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (মুসতাদরাক হাকিম ১৫৩২)
৩. পরিবেশ পাল্টান
গুনাহর পরিবেশ থেকে দূরে থাকুন। গুনাহর পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এটা নবীগণের একটি তরিকা। দেখুন, হযরত ইউসুফ আ. জুলাইখার কাছে ছিলেন। জুলাইখা তাঁকে গুনাহর প্রতি আহবান করেছিল। গোপন গুনাহর পরিবেশও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ইউসুফ আ. এই পরিবেশকে পছন্দ করলেন না। তিনি গুনাহর পরিবেশ -যদিও তা ছিল আরাম-আয়েশের- বর্জন করে জেলখানার পরিবেশ বেছে নিলেন। তবুও গুনাহর পরিবেশে থাকাটাকে তিনি পসন্দ করেন নি। বরং তিনি আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছিলেন,
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ
হে আমার রব! তারা আমাকে যে কাজের দিকে আহবান করে, তার চাইতে আমি কারাগারই পছন্দ করি। (সূরা ইউসুফ ৩৩)
সুতরাং আমরাও এটা করব। গুনাহর পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখব। বাসায় টিভি ভিসিআরের পরিবেশ পাল্টিয়ে সেখানে তালিমের পরিবেশ, আমলের পরিবেশ, তেলাওয়াতের পরিবেশ, জিকির-মুরাকাবা, দোয়ার পরিবেশ গড়ে তুলব। এর কারণে দুনিয়ার কিছু মজা তো ছাড়তে হবে। কিন্তু ছাড়বেন কার জন্য? আল্লাহর জন্য। আল্লাহর জন্য গুনাহর মজা ছাড়তে পাড়লে এর পরিবর্তে তিনি ঈমানের মজা দান করবেন। আর ঈমানের মজা তো এমন মজা যার জন্য কত মানুষ তাদের জানও দিয়ে দিয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাসে যার প্রমাণ হাজার হাজার আছে। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَنْ تَرَكَهَا مِنْ مَخَافَتِىْ اَبْدَلْتُهُ إِيْمَاناً يَجِدُ حَلَاوَتَه فِىْ قَلْبِه
যে আমার ভয়ে এগুলো ত্যাগ করবে, আমি তার অন্তরে এমন ঈমান সৃষ্টি করব যে, সে তার স্বাদ পাবে। (আততারগীব ওয়াততারহীব ২/৩৭)
অভিবাবকদের উদ্দেশ্যে আরেকটি কথা…
আমাদের সমাজের একটা নতুন ট্র্যান্ড হল, ছেলে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যাওয়ার পরেও অভিবাবকরা যথা সময়ে তাদেরকে বিয়ে-শাদি দেয় না। ফলে অবৈধ প্রেমসহ নানা ধরণের গোপন গুনাহয় তারা জড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে বয়সও বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে দেখা যায়, আর পাত্র বা পাত্রী খুঁজে পায় না। তখন মনে করে বসে, অমুক তাবিজ করেছে, অমুক বিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। এভাবে গীবত, অপবাদ, বদধারণাসহ আরো কত গুনাহ তৈরি হতে থাকে। এজন্য আমার সঙ্গে যারা মহব্বত রাখেন, বিশেষত তাদের প্রতি জোরালো তাগিদ দিচ্ছি যে, ছেলে মেয়ে বিশেষ করে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে বিয়ে দিয়ে দিতে দেরি করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার এ জাতীয় উদাসীনতার কারণে যদি আপনার মেয়ে কিংবা ছেলে গোপন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে এই গুনাহর ভার আপনার উপরও পড়বে। এর জন্য আপনাকেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
গোপন গুনাহর সবচেয়ে বড় ভয়াবহতা
শাইখুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া রহ. শাইখ আবু আব্দুল্লাহ উন্দুলুসী রহ. সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি ছিলেন সমকালীন বিখ্যাত ওলী, মুহাদ্দিস ও কালের জগদ্বিখ্যাত মনীষীদের অন্যতম। তার সহজ পরিচয়ের জন্য এতটুকু বলাই যথেষ্ট। পৃথিবীখ্যাত ওলী হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহ. ও হযরত শিবলী রহ.-ও ছিলেন তাঁর শিষ্য। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে এক খ্রিস্টান সুন্দরী মেয়ের প্রতি তিনি কুদৃষ্টি দিয়েছিলেন। যার সুত্র ধরে তাঁর বেলায়েত চলে গিয়েছিল। এমন কি -আল্লাহর কাছে পানাহ চাই- তাঁর ঈমানের উত্তাপও নিভে গিয়েছিল। পরবর্তীতে তাঁর হাজার হাজার মুরিদানের দোয়া ও কান্নাকাটির উসিলায় আল্লাহ তাঁকে আবার কবুল করেছিলেন। হারানো মর্যাদা ফিরে পেয়েছিলেন। বোঝা গেল, কুদৃষ্টি, বেপর্দা, গোপন গুনাহ এমন এক গুনাহ যার কারণে -আবারো আল্লাহর কাছে পানাহ চাই- ঈমান পর্যন্ত চলে যায়।
দোয়া করুন
গোপন গুনাহর কারণে ধীরে ধীরে ঈমান পর্যন্ত চলে যায়- কথাটা একজন ইমানদারের কলিজায় আগুন ধরে যাওয়ার মত কথা। এজন্য আমরা আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করব–
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الصِّحَّةَ وَالْعِفَّةَ وَالأَمَانَةَ وَحُسْنَ الْخُلُقِ وَالرِّضَا بِالْقَدَرِ
হে আল্লাহ! আপনার কাছে সুস্থতা, গুনাহমুক্ত জীবন, আমানতদারিতা, উত্তম চরিত্র ও তাকদিরের উপর সন্তুষ্টি প্রার্থনা করছি। (বাহ্রুল ফাওয়াইদ ১৫)
اللهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا تُحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ ، وَمَنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ
হে আল্লাহ! আপনার প্রতি এমন ভীতি আমাদেরকে দান করুন, যা আমাদের মাঝে এবং আমাদের গুনাহর মাঝে প্রতিবন্ধক হবে এবং এমন আনুগত্য দান করুন, যা আমাদেরকে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছাবে। (তিরমিযী ৩৫০২)
গোপন গুনাহর চিন্তা আসলে ভাবুন…
ডা. আব্দুল হাই আরেফী রহ. বলতেন, যখন গুনাহর চিন্তা মাথায় আসবে, তখন এটা চিন্তা করবে যে, গুনাহটি তুমি তোমার প্রিয়জন যেমন, তোমার মা-বাবা, উস্তাদ, শায়েখ, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এদের সামনে করতে পারবে কিনা? যদি না পার তাহলে তারা তো এখানে উপস্থিত নেই, কিন্তু আল্লাহ তো আছেন। সুতরাং তার সামনে কিভাবে গুনাহটি করবে? তাছাড়া আল্লাহ তো বলেছেন, সুতরাং কেয়ামতের দিন আমার প্রিয়জনদের সামনে আমার গুনাহটি প্রকাশ পেয়ে গেলে তখন আমার অবস্থা কেমন হবে?
কিছু কিছু গুনাহর ক্ষেত্রে এই ভাবনাটাও বেশ কাজে আসে।
মা-বোনদের জন্য বিশেষ উপদেশ
এজন্য পরিশেষে মা-বোনদেরকে বিশেষভাবে বলছি, দয়া করে বেপর্দায় চলে আপনি একজন শত শত পুরুষের গুনাহর কারণ হবেন না। শয়তানের রশি হবেন না। হাদিসে বেপর্দা নারীকেحَبَائِلُ الشَّيْطَانِ তথাশয়তানের রশি বলা হয়েছে। সব নারীকে শয়তানের রশি বলা হয় নি। বরং নেককার নারী সম্পর্কে বলা হয়েছে,
إِنَّمَا الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَلَيْسَ مِنْ مَتَاعِ الدُّنْيَا شَيْءٌ أَفْضَلَ مِنْ الْمَرْأَةِ الصَّالِحَةِ
‘দুনিয়ার সব কিছু সম্পদ।’ মানবসম্পদ (Manpower ) তো শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর মানবসম্পদের মধ্যেও ‘শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল, নেককার নারী। ‘নেককার নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ পৃথিবীতে দ্বিতীয় টি নেই। (ইবন মাজাহ ১৮৫৫)
দয়া করে আপনারা পুরুষের জন্য ফেতনার কারণ হবেন না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةً أَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ مِنْ النِّسَاءِ
আমার পরবর্তীতে পুরুষের জন্য নারীর ফিতনার চেয়ে কঠিন কোন ফিতনা আমি রেখে যায় নি। (সহীহ বোখারী ৪৮০৮ )
যাই হোক, আলোচনা একটু দীর্ঘ হয়ে গেছে। আল্লাহ আমাদের এই সময়গুলোকে কবুল করুন। এ পর্যন্ত যা বলা হয়েছে, তার উপর আমাদের প্রত্যেককে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ
আরো পড়ুন–