আসক্তি বা addiction: যে রোগে আমরা সকলেই রোগী

গোপন গুনাহর চিকিৎসা

আসক্তি (addiction)

(পর্ব ০১)

শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

হামদ ও সালাতের পর!

আল্লাহ তা’আলা নিজেদেরকে সংশোধন করার উদ্দেশ্যে তাঁরই জন্য কিছু সময় বের করার তাওফিক আমাদেরকে দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

আমরা সকলেই আসক্ত বা addicted

আজকে যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা হবে সেই বিষয়টার সাথে আমরা প্রত্যেকেই জড়িত। তবে পার্থক্য হলো এই–

كُلٌّ يَعْمَلُ عَلَىٰ شَاكِلَتِهِ فَرَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَنْ هُوَ أَهْدَىٰ سَبِيلًا

প্রত্যেকে তার নিজ নিজ রীতি অনুসারে কাজ করে। কিন্তু তোমার প্রতিপালক ভাল করে জানেন, কে সর্বাপেক্ষা নির্ভুল পথে আছে। (সূরা ইসরা ৮৪)

অর্থাৎ, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সুবিধামত জড়িত। এই বিষয়টার নাম হল আসক্তি বা addiction. কেউ যখন আসক্ত হয় তখন তাকে বলা হয় addicted. যুবক হলে পর্ণাসক্তি , মাস্টারবেশনে আসক্তি অথবা নেশা বা মাদকাসক্তি । আর যদি বুড়ো টাইপের হয় তবে পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়ার নেশা। শক্তি নেই, দুর্ঘটনা ঘটাবে এরকম সুযোগও সে পাবে না জানে; তবু রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে থাকে। কাজের মেয়েকে ‘মা’ বলে ডাক দেয়,  মনে কিন্তু অন্য চিন্তা। স্কুল ছুটি হলে দাঁড়িয়ে থাকে। এটাও এক প্রকার আসক্তি। এই বুড়োও addicted. বাচ্চা মানুষ হলে গেম আসক্তি। এমনও হয় যে, বাচ্চা খানা খায় না  অথবা কথা শোনে না, মোবাইলটা হাতে দিয়ে দিলে খানা খাচ্ছে। একবার আমাকে এক ভাই শোনাচ্ছিলেন, তার সন্তানের খবর। বলছিলেন, হুজুর, সন্তানের বয়স চার বছর/সাড়ে চার বছর। আগে বুঝি নাই। এই ৫/৬ মাস থেকে তওবা করছি। এখন বাচ্চার হাতে হিন্দি গান না দিলে খানা খায় না। গেম দিলেও খানা খায় না। কুরআন তিলাওয়াত বা অন্য কোন কিছু দিলেও খায় না। ওই হিন্দি গানটাই দিতে হবে। এটাও আসক্তি। এই বাচ্চা মোবাইল addicted. আমরা অনেক দ্বীনদার আছি বিভিন্ন সিরিয়ালে আসক্ত। এখন বিভিন্ন সিরিয়াল আছে। হিন্দি সিরিয়ালতো আছেই। কত বছর আগে শুরু হয়েছে কে জানে, আবার কত বছর পর গিয়ে শেষ হবে তাও জানা নাই! আবার ইদানিং কালে ইসলামের নামেও কিছু সিরিয়াল আছে। অনেকে ওগুলাতেও আসক্ত। এভাবে প্রত্যেকেই যদি চিন্তা করি তাহলে এই আসক্তির ব্যপারটা কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই আছে। তবে পার্থক্য হলো كُلٌّ يَعْمَلُ عَلَىٰ شَاكِلَتِهِ  বুড়া মিয়া বুড়ার মতো করে আসক্ত, যুবক যুবকের মতো করে আসক্ত। আর আমাদের মতো হুজুর যারা হুজুরের মতো করে আসক্ত। ‘মৌলভি কা শায়তান মৌলভি হোতা হেয়’ মৌলভি সাহেবের শয়তান মৌলভি সাহেব হয়! আমরা যারা হুজুর আমাদের শয়তানটাও হুজুর টাইপের। দিন শেষে আমরা প্রত্যেকেই আসক্ত।

এই আসক্তিটা কেন এবং ইসলাম কী চায়?

এই আসক্তিটা কেন? এই আসক্তিটা হল মানুষের স্বভাবজাত, সৃষ্টিগত। সুতরাং আমি আর আপনি যদি চাই যে, এটা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে–সম্ভব না। ইসলাম কী চায়? ইসলাম বলে এটাকে নিয়ন্ত্রন কর। এটাকে ঘুরিয়ে দাও। তোমার  মধ্যে যে স্বভাবটা আছে এটাকে ভালো দিকে নিয়ে যাও। তোমার এই নফসের চাহিদা, আসক্তি এটা কিন্তু চলমান। তুমি চাইলেও এটাকে বন্ধ করতে পারবে না। তবে এর দৃষ্টান্ত হল, আটা পিশার চাকতির  মতো। চাকতির  নিচে যদি আমরা গম রাখি আটা বের হবে, বালু রাখলে বালি বের হবে, ইট রাখলে ময়লা বের হবে, ময়লা রাখলে ময়লা বের হবে। অনুরূপভাবে আমরা যদি আসক্তির জায়গায় দ্বীনের আসক্তিগুলো রেখে দিতে পারি, নেক আমলের প্রতি আগ্রহ। আসক্তির জায়গার আগ্রহ এনে দিতে পারি। হালাল জিনিসের প্রতি আগ্রহ। যদি আমরা এনে দিতে পারি তাহলে এই জিনিসটাই আমাদের অনেক সুন্দর কাজে দিবে । এই জিনিসটাই আমাদের মধ্যে অনেক নেক আমালের জন্ম দিবে।

আমাদের মধ্যে কোন আসক্তি বেশি প্রবল ?

আসক্তির মধ্যে কোন আসক্তি আমাদের মধ্যে বেশি প্রবল? পরনারীর প্রতি আসক্তি; এটাই আমাদের মধ্যে সবচাইতে বেশি প্রবল। এই আসক্তির রোগে সবাই রোগী। যুবক এই আসক্তির রোগে রোগী  হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে। আর যারা সিনিয়র তারা এই আসক্তির রোগে রোগী  খবর দেখার নামে। রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে। অথবা রাস্তায় চলাচলের মাধ্যমে। অনুরূপভাবে পরনারী পরপুরুষের প্রতি আসক্ত। এটা হল এক নম্বরে। এটা যে এক নম্বরে নবীজী ﷺ এই আশংকাটা ১৫০০ বছর আগে করেছেন। নবীজী ﷺ ১৫০০ বছর আগে বলে গেছেন,

مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةً هِيَ أَضَرُّ عَلَى الرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ

আমি চলে যাওয়ার পরে আমার উম্মতের জন্য সব চাইতে ক্ষতিকর যেই ফিতনা রেখে যাচ্ছি সেটা হল, একজন পুরুষের জন্য একজন নারীর প্রতি আসক্তি। (সহিহ বুখারী ৫০৯৬ সহিহ মুসলিম ২৭৪০)

নারীর প্রতি এই আকর্ষণ কত বড় বড় সুফি সাহেবকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছে! অনেক বড় বড় মানুষকে রাস্তা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে! পরনারীর প্রতি আসক্তি কত সুন্দর সংসারকে ধংস করে দেয়! কত সুন্দর পরিবেশকে ধংস করে দেয়! কত নেককার মানুষকে শয়তানের গোলাম বানিয়ে ছাড়ে! পরনারীর প্রতি আকর্ষণের কারণেই তো যুবকেরা পর্নমুভি দেখে! আরো কত খারাপ খারাপ জিনিস দেখে এই আকর্ষণের কারণেই তো! এজন্যই নবীজি ﷺ এটাকে আসক্তির তালিকায় এক নাম্বারে রেখেছেন।

মুসলিম বানানোর উদ্দেশ্যে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা

অনেক যুবক আসে আমাদের কাছে বলে, হুজুর! অমুক হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছি। এখন মুসলমান করে বিয়ে করা যাবে? ভাই, মুসলমান করে বিয়ে করার দ্বায়িত্ব আল্লাহ তোমাকে দেন নাই। তোমাকে দ্বায়িত্ব দিয়েছেন পরনারী থেকে দূরে থাকার। সে যে বাস্তবে মনের দিক থেকে ইসলাম গ্রহণ করবে; এর কী নিশ্চয়তা! বরং ৯০ ভাগ আশংকা–না, না ১০ ভাগও আমি রাখতে পারবো না; বরং ৯৮ ভাগ ৯৯ ভাগ আশংকা এইযে, সে তোমাকেই হিন্দু বানিয়ে ছাড়বে! কারণ মানুষের স্বভাব হলো, মানুষ যখন একসঙ্গে থাকে, কারো সহবতে থাক, সংস্পর্শে  থাকে আর সঙ্গীটা যদি ভালো হয় তখন তার ভালো স্বাভাবটা খারাপ লোকটা গ্রহণ করে একটু দেরিতে। সময় নেয়। পক্ষান্তরে ভালো লোকটা যদি সে নফসের গোলাম হয় তবে সে খারাপ লোকের স্বভাব গ্রহণ করে খুব দ্রুত। নেক আমল যায় উপরের দিকে আর বদ আমল যায় নিচের দিকে। বলেন তো গতি উপরের দিকে বেশি না নিচের দিকে? একটা জিনিস ছাড়লে সেটা নিচের দিকে তাড়াতাড়ি আসে আর উপরের দিকে দেরিতে যায়। এজন্যই মন্দের প্রভাব ভালো জিনিসের চাইতে দ্রুত বিস্তারকারী হয়।

টয়লেটে বসে জিকির করা যাবে কি না?

প্রাসংগিক একটা চুটকি মনে পড়ল। এক মুহাদ্দিসকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, টয়লেটে বসে জিকির করা যাবে কি না? টয়লেটে বসে মুখে জিকির করা তো যাবে না। কিন্তু তিনি বলতেন যে, যাবে। মনে মনে জিকির করা যে যাবে এটা সবাই বলেন। বরং জিকিরতো করতে হবে নতুবা সেখানে নানা ধরণের কুচিন্তা মাথায় আসে। টয়লেটে বসে জিকিরে কলবি করতে হবে। মনে মনে জিকির করতে হবে। যেমন এভাবে চিন্তা করতে পারেন যে, আল্লাহ আমাকে এখানেও দেখতে পাচ্ছেন। আমি কতটা অসহায়ভাবে বসে আছি; এটাই আমার হাকিকত। নগ্ন হয়ে বসে আছি, পেট থেকে নাপাক যাচ্ছে। আমি এটাই। এটাই আমার পরিচয়। এভাবে চিন্তা করলে অহংকার কমবে। আর পাশাপাশি জিকরে কলবি জারি রাখা। মুখে জিকির নিষেধ। কিন্তু ওই মুহাদ্দিস বলতেন যে, মুখেও জিকির করা যাবে। তো উনি যুক্তি দিতেন, দেখো নাপাকি যায় নিচের দিকে আর জিকির যায় উপরের দিকে। একটার সাথে আরেকটার কী সম্পর্ক!

إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ

তাঁরই দিকে পবিত্র বাণীসমূহ আরোহণ করে আর সৎকাজ সেগুলোকে উচ্চে তুলে ধরে। (সূরা ফাতির ১০)

বদ আমলের প্রভাব খুব দ্রুত ছড়ায়

তো যেটা বলতে চেয়েছিলাম যে, নেক আমলের তাসিরটা একটু দেরিতে হয়। তবে স্থায়ী হয়, শক্তিশালী হয়, বরকতময় হয় এবং এই তাসিরের কারণে একজন মানুষ সংশোধন তো হয়েই যায় সাথে অন্যের সংশোধনেরও কারণ হয়। পক্ষান্তরে বদ আমলের প্রভাবটা খুব দ্রুত ছড়ায়। যেমন ধরুন, একটা খুব সুন্দর পরিবেশ। এই পরিবেশটা হয়তো গড়তে সময় লেগেছে ১০ বছর। একজন এসে হঠাৎ করে একটা ঝগড়া বাধিয়ে দিলো। কতক্ষণ লাগল বলেন? ঝগড়াটা তৈরি করতে কতক্ষণ লেগেছে! হয়তো এক মিনিট। কিন্তু এই ১০ বছরের অর্জন শেষ! তাহলে বুঝা গেল, বদ আমলের তাসির বেশি দ্রুত ছড়ায়। আপনি এক শিশি আতর রাখেন আর পাশে এক বালতি ময়লা রাখেন। আপনার নাকে কোনটার গন্ধ আগে আসবে? ময়লাটার গন্ধ আগে আসবে। তাহলে বুঝা গেল, ময়লা জিনিসের দূর্গন্ধ আগে ছড়ায়। সুগন্ধির সুগন্ধটা একটু দেরিতে ছড়ায়। তবে ছড়ায়। এই কারণেই দুনিয়ার মধ্যে পথভ্রষ্ট লোকের সংখ্যা বেশি। আর আল্লাহ তাআলা নবীজি ﷺ-কে বলেছেন যে, আপনি অধিকাংশ লোকদের কথা শুনবেন না। কারণ অধিকাংশই পথভ্রষ্ট। আল্লাহ বলেন,

وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِى ٱلْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا ٱلظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ

আপনি যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের অনুসরণ করেন তাহলে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করে ফেলবে, তারা তো কেবল আন্দাজ-অনুমানের অনুসরণ করে চলে, তারা মিথ্যাচার ছাড়া কিছু করে না। (সূরা আনআ’ম ১১৬)

আল্লামা আন্দুলূসি রহ. এবং খ্রিষ্টান মেয়ে

আল্লামা আন্দুলূসি রহ. যাচ্ছিলেন হজের সফরে। পথিমধ্যে এক খ্রিষ্টান মেয়ের প্রতি তার দৃষ্টি পড়ে গেল। এবার তিনি ওই মেয়ের প্রেমাসক্ত হয়ে পড়লেন। মেথরের মেয়ে । শূকর চরায়। কিন্তু ছিল যথেষ্ট সুন্দরী। এখন গিয়ে তিনি ওই খ্রিষ্টান মেয়েটার পিছনে পিছনে চলা শুরু করলেন। এরপর হলো কী; ঘটনা বলতে গেলে মূল আলোচনায় যেতে পারবো না। শুধু এতটুকু বুঝেন, তিনি ওই খ্রিষ্টান মেয়ের প্রেমে পাগল হয়ে তার হাজার হাজার লাখ লাখ মুরিদ সব পিছনে ফেলে রেখে শেষ পর্যন্ত ওই মেয়ের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন! মেয়েটির বাবা উত্তর দিল, আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হলে তোমাকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি এটাও করে ছাড়লেন। (নাউযুবিল্লাহ)। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, এই আসক্তিটা কতটা জঘন্য পর্যায়ের! অবশ্য পরবর্তীতে তিনি তাঁর মুরিদদের দোয়ার উসিলায় তাওবা করে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ।

বুয়েট টিচারের তাওবা

আমি এরকমও শুনেছি, আমার কাছে এসে এক যুবক তওবা করছিলো। বুয়েটের নব নিযুক্ত টিচার। তার বক্তব্য ছিল এরকম যে, সে ইন্টারমিডিয়েটের সময় থেকে পর্ণ আসক্ত। এখন সে বুয়েটের শিক্ষক। তখন থেকে সে কবে রাতে ঘুমিয়েছে- ভুলে গেছে।

আল্লাহ মাফ করুন। হতে পারে, আমাদের মধ্যেও কোন যুবকের সাথে এই ঘটনাটা মিলে যাচ্ছে। আপনার জন্য আমার জন্য হয়তো গল্প হতে পারে। কিন্তু কারো জন্য এটাই বাস্তব হতে পারে।

তো তার বক্তব্য ছিল, সে কবে রাতে ঘুমিয়েছে–ভুলে গেছে। ইসলামপ্রেম তার অন্তরে বিদ্যমান। তাই কখনো কখনো হয়তো সে ফিরে আসার চেষ্টা করেছেও; কিন্তু ফেরত  আসতে পারে নাই।

একবার চিন্তা করে দেখুন, ইন্টারমিডিয়েট থেকে নিয়ে বুয়েটের টিচার হওয়া পর্যন্ত কত বছর সময় লাগে!? এই বিশাল সময়ের মধ্যে কবে সে রাত ঘুমিয়েছে ভুলে গেছে। তাহলে তার আসক্তিটা কোন পর্যায়ের ছিল! এটা ছিল পরনারীর প্রতি আকর্ষণের কারণে। পরনারীর প্রতি আসক্তির কারণে তাকে এই নোংরা অভ্যাস পেয়ে বসেছিল।

নেশা: নানা প্রকার অপকর্মের প্রসূতি

আসক্তির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, নেশা বা মাদকাসক্তি। নবীজি ﷺ এটাকে বলেছেন أمُّ الخبائث তথা নানা প্রকার অপকর্মের প্রসূতি মা।  যে লোক এই নেশাতে পড়ে যায় তাকে আর অপরাধ দেখাতে হয় না। কেননা, সে নিজেই নানা অপরাধের জন্মদাতা বনে যায়। যাবতীয় অপরাধ এখন তার থেকে ঘটতে থাকবে। সকল অপরাধের মূল হলো এটা। ইয়াবা, গাঁজা, হিরোয়িন আরো কত কিছু যে কত নামে আছে!

হাদিস শরিফে এসেছে, পূর্ববর্তী যুগে এক আবেদ ব্যক্তি ছিল। এক কুলটা নারী তাকে নিজের ধোঁকাবাজির জালে আবদ্ধ করতে মনস্থ করে। এজন্য সে তার এক দাসীকে তার নিকট সাক্ষ্যদানের জন্য ডেকে পাঠায়। তখন ঐ আবেদ ব্যক্তি ঐ দাসীর সাথে গমন করলো। সে যখনই কোন দরজা অতিক্রম করত, দাসী পেছন থেকে সেটি বন্ধ করে দিত। এভাবে সেই আবেদ ব্যক্তি এক অতি সুন্দরী নারীর সামনে উপস্থিত হলো আর তার সামনে ছিল একটি ছেলে এবং এক পেয়ালা মদ। সেই নারী আবেদকে বললো, আল্লাহর শপথ! আমি আপনাকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডেকে পাঠাই নি; বরং এজন্য ডেকে পাঠিয়েছি যে, আপনি আমার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হবেন অথবা এই মদ পান করবেন অথবা এই ছেলেকে হত্যা করবেন। সেই আবেদ বললো, আমাকে এই মদের একটি মাত্র পেয়ালা দাও। ওই নারী তাকে এক পেয়ালা মদ পান করালো। তখন সে বললো, আরও দাও। মোটকথা, ওই আবেদ আর থামল না, যাবৎ না সে তার সাথে ব্যভিচার করলো এবং ঐ ছেলেকেও হত্যা করলো। (নাসায়ী ৫৬৬৬)

খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা

মুহতারাম হাজিরীন! তাহলে আসক্তির তালিকায় এই দুইটাই প্রধান–এক. পরনারীর প্রতি আসক্তি। দুই. মাদকাসক্তি। বাকি অন্যান্য আসক্তির অবস্থান এ দু’টির পরে। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। আল্লাহ আমার ধারণা ভুল করুন– আমার ধারণা মতে আমরা সবাই কম বেশি অন্তত প্রথম রোগে রোগী। এছাড়াও আমরা প্রত্যেকেই কোন না কোন গুনাহতে আসক্ত।

এবার শুনুন একটি কথা এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। সেটা হল, যে গুনাহগুলো আমাদের মাঝে মাঝে হয়ে যায়, সে গুনাহগুলো নিয়ে কোন টেনশন নাই। কেন টেনশন নাই? কারণ এই গুনাহগুলো তওবা, নেক আমল, এই যে মসজিদে আসা যাওয়া করছি, এই যে একটু নেক আমল করছি, এই যে একটু কান্নাকাটি করছি, এই যে কিছু আস্তাগফারুল্লাহ বলছি, এই যে লজ্জিত হয়ে যাচ্ছি–এই আমলগুলোর কারণে, এই আমলগুলোর উসিলায় মাঝে মাঝে হয়ে যাওয়া গুনাহগুলো একেবারে মিটে যায়! সুবহানাল্লাহ! এসবের উসিলায় এজাতীয় গুনাহগুলো আমাদের আমলনামায় টিকে থাকতে পারে না।

কোন গুনাহগুলো আমাদের জীবনের জন্য সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ?

তাহলে আমাদের জীবনের জন্য সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ কোন গুনাহগুলো? আমাদের জীবনের জন্য সবচাইতে ভয়াবহ কোন গুনাহগুলো?

ওই গুনাহগুলো যেই গুনাহগুলো আসক্তির পর্যায়ে। আসক্তির পর্যায়ে যে গুনাহগুলো সেগুলোই আমাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিচার দিবসে এমনটা খুব কম হবে যে, একজন ব্যক্তি হাজার হাজার আইটেমের গুনাহের কারণে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বরং একই আটেমের গুনাহ বারবার বারবার এবং বারবার করার কারণে জাহান্নামে গেছে এমনটা বেশি ঘটবে। আল্লাহ তাআলা একথাই বলেন যে, بَلَىٰ مَن كَسَبَ سَيِّئَةً হ্যাঁ, যে ব্যক্তি গুনাহ করে। অর্থাৎ গুনাহ করে হয়ত একটা। ব্যাস! তারপর মজা পেয়ে যায় এবং একটা পর্যায়ে وَأَحَٰطَتْ بِهِۦ خَطِيٓـَٔتُهُ ওই গুনাহটা তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। একটা বাউন্ডারি তৈরি দেয়। সে ওই গুনাহটিতে আসক্ত হয়ে যায়। কার কথা? আল্লাহর কথা। আল্লাহ বলেন, وَأَحَٰطَتْ بِهِۦ خَطِيٓـَٔتُهُ গুনাহটা তার চারিদিকে ঘিরে ফেলে। এখন সে এখান থেকে আর বের হতে পারে না। আল্লাহ বলেন, فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصْحَٰبُ ٱلنَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَٰلِدُونَ  সুতরাং এরাই জাহান্নামী। এই টাইপের গুনাহর কারণে এরা জাহান্নামে যাবে এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামে যাবে। (সূরা বাকারা ৮১)

মানুষের গুনাহ  হবেই

সুতরাং হঠাৎ যে গুনাহটা হয়ে যাচ্ছে, এগুনাহটাও ভয়ের তবে এতটা ভয়ের না। এর জন্যে তওবা করে নিব। আচমকা এক/দু’টি গুনাহ হয়ে যাওয়াটা জীবনের একটা স্বাভাবিক অংশ।

হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেন, কেউ যদি বলে যে, তার গুনাহ হয় না তাহলে সে হয় ইবলিস আর না হয় ফেরেশতা। ইবলিস মানে সে ইবলিসের মত মিথ্যাবাদী। ফেরেশতা মানে গুনাহ করার সক্ষমতা তার নেই। কারণ, মানুষের গুনাহ  হবেই। তিনি আরো বলতেন, মুমিন গুনাহ করে না; তার গুনাহ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে শয়তানের গুনাহ হয় না; বরং সে ইচ্ছাকৃতভাবে গুনাহ করে।

এজন্যই হাদিসে এসেছে, নবীজি ﷺ বলেছেন,

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لو لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللَّهُ بِكُمْ، وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ، فَيَسْتَغْفِرُونَ اللَّهَ فَيَغْفِرُ لهمْ

যে সত্তার হাতে আমার জীবন, আমি তার কসম করে বলছি, তোমরা যদি গুনাহ না করতে তবে অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে এমন আরেকটি জাতি সৃষ্টি করতেন যারা গুনাহ করে ক্ষমা চাইতো, তাওবা করত, ইস্তেগফার করত আর বিনিময়ে আল্লাহ তাদের মাফ করে দিতেন। (সহিহ মুসলিম ২৭৪৯)

আল্লাহকে sorry বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন

উক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায়, আল্লাহকে sorry বলাটাকে আল্লাহ খুব পছন্দ করেন। তাই আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহগুলোর কথা স্বীকার করে নিয়ে তাঁকে sorry বলুন। অর্থাৎ ইস্তেগফার করুন। আর এই কারণেই আমাদের গুনাহ হয়। إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ আল্লাহ তওবাকারীকে খুব ভালোবাসেন। অনুতপ্ত হয়ে তাঁর কাছে চোখের পানি দিন। ফেরেশতাদের যেহেতু গুনাহ হয় না, তাই তারা লজ্জিত হয়ে কান্না করতে পারে না; অন্য কারণে হয়ত পারে। কিন্তু গুনাহের কারণে অনুতপ্ত হয়ে যে কান্নাকাটি করা এটা তারা পারে না। এজন্য আল্লাহর কাছে এই কান্নাকাটির ডিমান্ড বেশি। আর নিয়ম হল, যেই জিনিসের ডিমান্ড বেশি কিন্তু সাপ্লাই কম ওই জিনিসের মূল্য বেশি হয়।

চোখের পানির মূল্য অনেক!

তো একদিকে আল্লাহ তাআলার কাছে চোখের পানির ডিমান্ড বেশি, অপরদিকে মাখলুকের পক্ষ থেকে এর সাপ্লাই কম। কারণ, ফেরেস্তারা অনুতপ্ত হয়ে কাঁদতে পারে না, অন্যান্য মাখলুকও লজ্জিত হয়ে কাঁদতে পারে না, মানুষের মধ্যে অধিকাংশই অনুতপ্ত হয়ে চোখের পানি দেয় না–গোটা দুনিয়ার মধ্যে কান্নাকাটি করনেওয়ালা বান্দার খুবই অভাব। তাই এর দামও বহু গুণ বেড়ে যায়। এমনকি নবীজি ﷺ  বলেন, এক ফোঁটা দাও,  মাত্র এক ফোঁটা, وَإِنْ كَانَ مِثْلَ رَأْسِ الذُّبَابِ মাছির মাথা পরিমাণ হলেও চলবে। কেননা, এর দাম এতই বেশি যে, যে বান্দা নিজের গুনাহর ব্যাপারে লজ্জিত হয়ে এই সামান্য পরিমাণ চোখের পানি দিতে পারবে إِلَّا حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ আল্লাহ তাআলা তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন। সুবহানাল্লাহ! (ইবনু মাজাহ ৪১৯৭)

মানুষ মানেই ভুল করবে

তো যেটা বলতে চেয়েছিলাম, এই যে আমাদের যে গুনাহগুলো হঠাৎ হঠাৎ হয়ে যায়। এই গুনাহগুলো নিয়ে খুব একটা টেনশনের কারণ নেই। এটা আমাদের জীবনের একটা পার্ট। জীবনের একটা অংশ। অনিচ্ছাকৃতভাবে গুনাহ হয়ে যাবে। الناس من النسيان أول الناس أول ناس নাস মানে মানুষ । এটি النسيان থেকেএসেছে।  যার অর্থ ভুল করা। সুতরাং মানুষ মানেই ভুল করবে। মানুষ মানেই তার গুনাহ হবে। এজন্য আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, رَبَّنَا لاَ تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا ওগো আল্লাহ! হে আমাদের রব! যদি ভুলে যাই অথবা ভুলে করে ফেলি তাহলে মাফ করে দিন। সুতরাং মানুষ বলতেই এরকম হবে। এটা এত টেনশনের কিছু না!

কিন্তু যুবক! তুমি যে রাতের পর রাত জেগে মুভি দেখ; এটা তোমার জন্য টেনশনের বিষয়। এই গুনাহটাই তোমাকে ধ্বংস অতল খাদে নিয়ে যাচ্ছে। আশা করি আমি আপনাদের নির্দিষ্ট করে দিতে পেরেছি এবং পুরোপুরি নির্দিষ্ট করে দিতে পেরেছি যে, আল্লাহ মাফ করুন, আল্লাহর কাছে পানাহ চাই,  যদি কোন ব্যক্তি জাহান্নামে যায় তাহলে কোন গুনাহের কারণে যাবে। রাস্তায় হেঁটেছেন আর হঠাৎ একটা গুনাহ হয়ে গেছে ওই গুনাহটির কারণে নয়। ৬ মাস পর ৯ মাস পর একটা গুনাহ হয়ে গেছে ওই গুনাহটির কারণেও নয়; বরং ওই গুনাহটির কারণে যে গুনাহয় আপনি আসক্ত।

কোন গুনাহটিতে আপনি আসক্ত তা find out করুন

সুতরাং আপনি নিজে নিজে চিন্তা করে দেখুন, আপনি কোন গুনাহে আসক্ত–সুদের কারবারে, ঘুষের কারবারে, মিথ্যা কথায়, গীবতে, চোগলখুরিতে, কুদৃষ্টিতে, পর্ণ দেখাতে নাকি সিরিয়াল দেখাতে? আপনি কোন গুনাহটিতে আসক্ত তা find out করুন। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে খুঁজে বের করুন। তারপর ওটাকেই টার্গেট করুন যে, ওটাকে আমার মিটাতেই হবে। ওটাকেই জীবনের খাতা থেকে একেবারে মুছে দিতে হবে। ওটারই চিকিৎসা করতে হবে। কারণ যদি জাহান্নামে যেতে হয় তাহলে এই গুনাহটার কারণেই যেতে হবে। বাকিগুলো হল এই গুনাহের প্রতিক্রিয়া।

নামাজে কেন মনোযোগ আসে না? ওই যে রাত ২ টার যে গুনাহয়  আপনি আসক্ত তার কারণেই আসে না। জিকির কেন ভালো লাগে না? ওই যে রিমোট কন্ট্রলটার কারণে–যেটা এখনও ছাড়তে পারছেন না। কেন আমার কাছে কান্নাকাটি ভালো লাগে না? কান্নাকাটি আমার কেন আসে না? ওই যে সুদ কিংবা ঘুষ কিংবা গীবত–যেটা এখনও ছাড়তে পারি নাই, ওটার কারণে। বাকিগুলো সবই এটার প্রতিক্রিয়া। একটা বা দুইটা গুনাহ–যে যে কয়টাতে অভ্যস্ত–ওই গুনাহটাই হলো জাহান্নামে যাওয়ার কারণ।

আল্লাহ আমাদের ওই গুনাহটা থেকে বের হয়ে আসার তাওফিক দান করুন (আমিন)।

আরো পড়ুন: পর্ব ০২: পর্ণগ্রাফি, নেশা ইত্যাদিতে আসক্ত হওয়ার কারণসমূহ

আরো পড়ুন: আসক্তির (addiction) চিকিৎসা