ইন্টারনেট জগতের গুনাহ: ভয়াবহতা এবং বাঁচার ১২ টি আমল ও কৌশল

যে ব্যক্তি বদঅভ্যাসের বেড়াজাল থেকে বের হতে চায়, তার প্রতি নসিহত

ইন্টারনেট জগতের গুনাহ

ভয়াবহতা এবং বাঁচার ১২ টি আমল ও কৌশল

(পর্ব ০২)

সবচেয়ে ক্ষতিকর ফেতনা

ইন্টারনেট জগতের গুনাহগুলো কী কী–তা আমাদের অজানা নয় এবং আমরা এও জানি যে, এই জগতের গুনাহর স্বরূপ ও ধরণ যেমনই হোক না কেন; তবে এর অধিকাংশই যৌনতা রিলেটেড গুনাহ। হাদিসে এই ফেতনাকে বলা হয়েছে, নারীর ফেতনা। রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর ভাষায়,

ما تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةً أضَرَّ علَى الرِّجالِ مِنَ النِّساءِ

পুরুষের জন্য স্ত্রীজাতি অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর কোন ফেতনা আমি রেখে গেলাম না। (সহীহ বুখারী ৫০৯৬)

বোঝা গেল, এই ফেতনা অনেক ভয়াবহ। একে নারীর ফেতনা বলা হয়েছে কেন? কেননা, এই ফেতনার প্রধান অবলম্বন নারী এবং যৌনতা। সেক্সুয়্যাল এক্টিভিটিস এর প্রধান উপকরণ। নগ্নতা আর অশ্লীলতা এর প্রধান খোরাক।

সেল ফোন না হেল ফোন?

আমরা বলি, নেট। যার অর্থ জাল। ফেতনাও এক প্রকার জাল। আমাদের শায়খের ভাষায়, internet নয়, enter net অর্থাৎ, জালে ঢুকো। সেল ফোন তো নয় বরং হেল ফোন। hell অর্থ জাহান্নাম। অর্থাৎ, সেল ফোন দিয়ে, স্মার্ট ফোন দিয়ে এই জালে ঢুকো আর জাহান্নামে প্রবেশ কর।

আমরা এই জালে এখন এতটাই আবদ্ধ যে, এক দুই ঘণ্টার জন্য হয়ত কোথাও বসেছি, তখনও আমাদের চোখ চারিদিক খুঁজে  বেড়ায় ওয়াইফাই আছে কিনা। আহ! এই কিছু কাল আগেও যখন কেউ কারো বাসায় মেহমান হত তখন কুশলাদি বিনিময়ের পর কিংবা ঘুমানোর আগে মেজবান আর মেহমানের কথাবার্তা হত অনেকটা এরকম–অজুর ব্যবস্থা অমুক জায়গায়, ওয়াশরুম এদিকে, জায়নামাজ লাগবে কিনা ইত্যাদি। এই প্রজন্মের কাছে এগুলো এখন গল্প। আরো কিছুকাল পর মনে হবে এসবই কল্পকাহিনী। কেননা, এখনকার মেজবান আর মেহমানের কথাবার্তা হয় অনেকটা এরকম–ওয়াইফাই লাগবে? পাসওয়ার্ডটা কত? ইত্যাদি। ওয়াইফাইর পাসওয়ার্ড কেন দেয়া-নেয়া হয়, এটা তো ওপেন সিক্রেট। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।

নারী আপন ঘরে অবস্থান করার ফজিলত

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

المرأةُ عورةٌ

নারী হচ্ছে ‘আওরাত’ তথা আবরণীয়। (সুনান তিরমিযী ১১৭৩)

এজন্যই নারী তার ঘরেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। আমরা পুরুষরা আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হই কখন? যখন সিজদা দেই তখন। আর নারীরা যখন পর্দার সঙ্গে ঘরে অবস্থান করে তখন চব্বিশ ঘণ্টা এই সিজদার সাওয়াব পেতে থাকে। বিশ্বাস হয় না? তাহলে হাদিস শুনুন, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

أَقْرَبُ ما يَكونُ العَبْدُ مِن رَبِّهِ، وهو ساجِدٌ

বান্দা সিজদার সময়ে তার রবের সর্বাধিক নৈকট্য লাভ করে। (সহীহ মুসলিম ৪৮২)

অপর হাদিসে মহিলাদের ঘরে অবস্থান করার ব্যাপারে হুবহু একই ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

وأقربُ ما تكونُ مِن وَجْهِ ربِّها وهي في قَعْرِ بيتها

নারী সবচেয়ে বেশী সে তার পালনকর্তার নিকটবর্তী থাকে যখন সে নিজ ঘরের অভ্যন্তরে অবস্থান করে। (সহীহ ইবনু খুযাইমা ১৬৮৫ সহীহ ইবনু  হিব্বান ৫৫৯৮)

নারীকে যখন ড্রাইভ করে শয়তান

নারী তো ঘরের রানী। কিন্তু সে যখন নিজের ঘর ছেড়ে পরপুরুষের সামনে চলে আসে, এই আসাটা রিয়েল লাইফে হতে পারে কিংবা ফটো-ভিডিওর মাধ্যমে অনলাইনেও হতে পারে, সেলিব্রেটির সুরতে হতে পারে, আপনার আমার গার্লফ্রেন্ডের আকৃতিতে হতে পারে। আসলে কথিত সেলিব্রেটি কিংবা গার্লফ্রেন্ড তো এদের আধুনিক পরিবর্তিত নাম। অন্যথায় কোরআন হাদিসের দৃষ্টিতে এদের নাম হওয়া উচিত–ব্যভিচারিণী। মোটকথা যে সুরতেই সে সামনে আসুক না কেন; নবীজি ﷺ বলেন,

فإذا خرجتِ استشرفها الشَّيطانُ

যখন সে পর্দা ছেড়ে বের হয়ে পড়ে তখন শয়তান তার উপর ভর করে। (সুনান তিরমিযী ১১৭৩)

ফলে সে তখন নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না; বরং তাকে ড্রাইভ করে শয়তান। তখন শয়তান তাকে পরিচালনা করে।

চাইলে নেটকেন্দ্রিক গুনাহগুলো ত্যাগ করা সম্ভব

যাই হোক, আমরা এই গুনাহ থেকে বের হতে চাই তো? আপনার মনে হতে পারে, ফেতনাটি যেভাবে তুফান গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সুতরাং এথেকে বের হওয়ার কল্পনা করাও বৃথা। এই যুগে আদৌ কি এর মোকাবেলা করা সম্ভব?

আমি আপনাকে বলবো, মনে রাখবেন, আল্লাহ তাআলা সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু আমাদের উপর চাপিয়ে দেন না। কেননা, আল্লাহ বলেন,

لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا

আল্লাহ কোন ব্যক্তির উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু আরোপ করেন না। (সূরা বাকারা ২৮৬)

ইন্টারনেটকেন্দ্রিক যে সকল গুনাহ এগুলোও ছাড়ার নির্দেশ আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন। যদি আমাদের জন্য এগুলো ত্যাগ করা অসম্ভব হত তাহলে নিশ্চয় এই নির্দেশ দেয়া হতো না। আল্লাহ তাআলা তো বলেছেন,

وَذَرُواْ ظَٰهِرَ ٱلْإِثْمِ وَبَاطِنَهُ

তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন গুনাহ বর্জন কর। (সূরা আনআ’ম ১২০)

সুতরাং এ গুনাহগুলো ত্যাগ করা সম্ভব। চাইলে আমরা পারবো। হ্যাঁ, হয়ত কষ্ট হবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার স্বভাব তো হল, বান্দা আল্লাহর জন্য কোনো কষ্ট করলে তিনি তার প্রতিদান বাড়িয়ে দেন।

মর্দে মুমিন ঘাবড়ে যেতে পারে না

তাছাড়া ‘আলহামদুলিল্লাহ’ আমরা মুমিন।

وہ مرد نہیں جو ڈر جائیں حالات کے خونی منظر سے

جس دور میں جینا مشکل ہو اس دور میں جینا لازم ہے

ফেতনার উত্তালতা দেখে, যামানার রক্তচক্ষু দেখে মর্দে মুমিন ঘাবড়ে যেতে পারে না। ফেতনা যতই ফেনায়িত উঠুক, মর্দে মুমিন ভয় পায় না। সে যে কোনো পরিবেশের গোলাম হতে পারে না। বরং সে পরিবেশকে পাল্টে দিতে জানে। আরে…মর্দে মুমিন তো লক্ষ কাফেরকেও মনে করে মুর্দা। সেখানে তার সামনে এই ফেতনা কী! মনে রাখবেন, অন্তরে যদি আল্লাহর ভয় আর তার প্রতি ভালোবাসা স্থান করে নেয় তাহলে এই ফেতনা উড়িয়ে দেয়া মুমিনের পক্ষে মোটেও অসম্ভব নয়।

ফেতনার জামানায় আমল করার ফজিলত

রাসুলুল্লাহ ﷺ কত চমৎকারভাবে আমাদের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে ফজিলত বাজেট করিয়ে নিয়েছেন। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহাবায়ে কেরামকে শুনাচ্ছেন যে,

إنَّ مِنْ ورائِكُمْ أيامَ الصبرِ الصبرُ فيهِنَّ كَقَبْضٍ علَى الجمْرِ لِلْعَامِلِ فِيهَا أَجْرُ خَمْسِينَ قالوا يا رسولَ اللهِ أجْرُ خمسينَ منهم أَوْ خمسينَ مِنَّا قال خمسينَ مِنْكُمْ

তোমাদের পর এমন যুগ আসবে, যখন দীনের উপর সবর করে থাকা জ্বলন্ত অঙ্গার মুষ্টিবদ্ধ করে রাখার মতো কষ্টকর হবে। ওই সময় দীনের উপর আমলকারীর প্রতিদান হবে পঞ্চাশ জন পুরুষের সমান প্রতিদান। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রসূল! পঞ্চাশ জন পুরুষ তাদের মধ্য থেকে না আমাদের মধ্য থেকে? নবীজি ﷺ উত্তর দিলেন, বরং তোমাদের মধ্য হতে! (সুনান আবু দাউদ ৪৩৪১)

সুতরাং মনে রাখতে হবে, সব কিছুর আগে আমরা মুমিন। আলী রাযি. বলতেন, আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি আল্লাহর গোলাম এবং মুহাম্মদ ﷺ -এর উম্মত। আমরাও সব সময় একথাটা মনে রাখবো। এটাই আমাদের প্রধান পরিচয়। সুতরাং আমরা এই ফেতনার কাছে হার মানবো না, শয়তানের গোলাম হবো না। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের হিম্মত বাড়িয়ে দিন। আমীন।

হিম্মত করতে হবে

আবারও বলছি, ফেতনাটির মোকাবেলা করার জন্য আমাদেরকে হিম্মত করতে হবে। আল্লাহর উপর ভরসা করে এই আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে যে, ‘ইনশা আল্লাহ, আমি পারবো। আমার রবের সন্তুষ্টির জন্য ভার্চুয়াল দুনিয়ার এই চাকচিক্য থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবো।’ এই ভাবে প্রত্যয়ী হবেন, পাশাপাশি গুরুত্ব ও সতর্কতার সঙ্গে কিছু আমল ও পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। আমি বলছি না যে, এক দিনেই আপনি আব্দুল কাদের জিলানী বায়েজিদ বোস্তামী হয়ে যাবেন। বরং এত দিনের এই অভ্যাস থেকে পুরপোরি বের হওয়াটা হয়ত সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠবে না। সে-ই যে দিন থেকে ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, সে দিন থেকে হয়ত এর অপব্যবহার করে যাচ্ছেন। এখন রাস্তা পরিবর্তন করতে গিয়ে হয়ত মাঝে মাঝে হোঁচট খাবেন। তবুও আপনাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। হোঁচট খাওয়ার পর পড়ে থাকলে তো চলা শেখা হবে না। বরং দোয়া তাওয়াক্কুল সতর্কতা আমল ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন। আমীন।

–চলবে