ইন্টারনেট জগতের গুনাহ
ভয়াবহতা এবং বাঁচার ১২ টি আমল ও কৌশল
(পর্ব ০৩)
মুজাহাদা করতে হবে
চিকিৎসা পেলাম, বাঁচার কৌশলও জানলাম কিন্তু কেবল জেনেই গেলাম, সতর্ক হলাম না, হিম্মত করলাম না, পদক্ষেপ নিলাম না তাহলে মনে রাখবেন, যদি কেউ নিজের পায়ে কুড়াল মারতে চায় তাহলে তাকে বাঁচাবে কে! কেউ যদি আগুনে ঝাঁপ দিতে চায় তাহলে তাকে কে আছে রক্ষা করবে! এজন্য আবারও বলছি, মুজাহাদা করতে হবে, আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে। আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা করে সামনে বাড়তে হবে। তাহলে ‘ইন শা আল্লাহ’ আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি রহমতের দৃষ্টি দিবেন এবং এই ভার্চুয়াল অপশক্তির মোকাবেলা করতে পারবেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلْمُحْسِنِينَ
আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় তাদেরকে আমি অবশ্য অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন। (সূরা আনকাবুত ৬৯)
যাই হোক, এই পর্যায়ে ইন্টারনেট জগতের গুনাহ থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে আমি আপনাদের সামনে ১২ টি আমল ও কৌশল পেশ করছি। দোয়া চাই, যেন আমি নিজে আমল করেতে পারি। আপনাদের জন্যও দোয়া করি, আল্লাহ তাআলা যেন সকলকে আমল করার তাওফীক দান করেন। আমীন।
১ নং আমল: নেক মজলিসের সঙ্গে নিজে জুড়ে রাখবেন
সব সময় একজন হক্কানি আলেমের টাচে থাকবেন, তাঁর মজলিসে নিয়মিত অংশগ্রহণ করবেন। বলতে পারেন, ভেজালের এই জামানায় নেক মজলিস পাবো কোথায়? কার কথা শুনে নিজেকে সংশোধন করবো? কীভাবে বুঝবো যে, অমুক মজলিসটি নেক এবং আল্লাহ তাআলার কাছে মাকবুল। এর সমাধানও হাদিসে আছে। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত,
قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ جُلَسَائِنَا خَيْرٌ؟ قَالَ: مَنْ ذَكَّرَكُمُ اللهَ رُؤْيَتُهُ، وَزَادَ فِي عِلْمِكُمْ مَنْطِقُهُ، وَذَكَّرَكُمْ بِالْآخِرَةِ عَمَلُهُ
এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের বসার সঙ্গী বা মজলিস হিসেবে কোনটি সবচেয়ে উত্তম? রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, যার সাক্ষাৎ তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যার কথায় তোমাদের ইলম বেড়ে যায় এবং যার আমল তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (মুসনাদ ইবন আব্বাস রাযি. ৬৩৮)
সুতরাং যে শায়খের মজলিসে এই তিনটি প্রভাব অনুধাবন করবেন তাঁর মজলিসে নিয়মিত আসা-যাওয়া করবেন। তাঁর কথা শুনবেন। এমনকি মাঝে মধ্যে কোনো কাজ না থাকলেও তাঁর কাছে যাবেন, যতক্ষণ পারেন সময় দিবেন, যেতে দেরী হয়ে গেলে ফোন করে খোঁজখবর নিবেন এবং দিবেন। দেখবেন, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি, এর প্রভাব আপনি তখনও নিশ্চিত অনুভব করবেন, যখন রাতের অন্ধকারে আপনি স্মার্ট ফোনটা হাতে নিবেন। ব্রাউজিং করার সময় গুনাহর চিন্তা যখন আপনাকে তাড়িত করবে, তখন এই নেক সোহবতের নূর আপনি অনুভব করবেন।
دم كے دم میں قلب نورانی ہوئی
مرد حق سے ملکے حقا نی ہوئی
ধীরে ধীরে অন্তর আলোকিত হয়েছে, আল্লাহওয়ালার সঙ্গে মিলে হক্কানি হয়ে উঠেছে।
২ নং আমল: এই ফেতনা থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন
এতক্ষণে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ আমরা অন্তত এতটুকু তো বুঝে গেছি যে, ফেতনাটি কেয়ামতের দিন আমাদের জন্য ইস্যু হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ তাআলার ভাষায়,
أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَن يُصِيبَهُم بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ
আল্লাহ তাআলা তাদেরকে কিছু গুনাহর জন্য শাস্তি দিতে চান। (সূরা মায়েদাহ ৪৯)
আর এটাও আশা করি বুঝেছি যে, নেট-ফেতনা বর্তমানে আসক্তির পর্যায়ে। আল্লাহ তাআলার ভাষায়,
وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ
যে গুনাহ তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। (সূরা বাকারা ৮১)
সুতরাং কীভাবে এই আশা করতে পারেন যে, আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত ও সাহায্য ছাড়া গুনাহটি থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন! এই জন্যই আল্লাহ তাআলার নিকট মুক্তির জন্য দোয়া করবেন। তাঁর কাছে তাঁর বিশেষ রহমত কামনা করবেন।
কীভাবে দোয়া করবেন?
বলতে পারেন, কীভাবে দোয়া করবো? যদিও এ বিষয়ে হাদিসে বহু দোয়া শিক্ষা দেয়া আছে, সেগুলো যদি জানা না থাকে তাহলে নিজের মত করে নিজের ভাষাতেই দোয়া করুন। অন্তত এটা তো বলতে পারেন যে, হে আল্লাহ! আমাকে মোবাইলের গুনাহ থেকে বাঁচান। ওগো আল্লাহ! ইন্টারনেটের ফেতনা থেকে হেফাজত করুন। ওগো আল্লাহ! চোখের গুনাহ থেকে হেফাজত করুন। ওগো আল্লাহ! সময় নিয়ন্ত্রণ করার তাওফীক দান করুন।
তবে একটা ছোট্ট দোয়া আপাতত বলে দেই। দোয়াটি প্রত্যেক নামাজের পর করবেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর প্রিয় সাহাবী মুয়ায রাযি.-কে ওসিয়ত করেছেন যে, তুমি প্রত্যেক নামাজের পর দোয়াটি পড়বে; কখনো ভুল করবে না। দোয়াটি এই,
اللَّهُمَّ أَعِنِّي على ذِكرِكَ وشُكرِكَ وحُسنِ عبادَتِكَ
হে আল্লাহ! আপনার স্মরণে, আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে এবং আপনার উত্তম ’ইবাদাতে আমাকে সাহায্য করুন। (সুনান আবু দাউদ ১৫২২)
আমরা জানি, নামজের পরে দোয়া কবুল হয়। সুতরাং দোয়াটি যদি একবার কবুল হয়ে যায় তাহলে ফেতনাটি থেকে বের হয়ে আসা ‘ইন শা আল্লাহ’ সহজ হয়ে যাবে।
৩ নং আমল: মাঝে মাঝে নির্জনে চোখের পানি দিবেন
দোয়া তো করবেন। এর জন্য কোনো সময় নেই; বরং যখন মনে চায় তখনই দোয়া করবেন। এমনকি দোয়ার জন্য হাত তোলাও জরুরি নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে নির্জনে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটিও করতে হবে। কেননা, গুনাহটা তো এই চোখ দ্বারাই হয় এবং নির্জনে বেশি হয়। সুতরাং নির্জনে কিছু চোখের পানিও দিতে হবে। এটা সাধারণ দোয়া থেকে স্পেশাল। এই চোখের পানির অনেক দাম। আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম আলাইহিসসালামকে বলেন, হে ইবরাহীম! জাহান্নামের আগুনকে নেভানোর শক্তি কোনো পানির নেই। একটা পানি ছাড়া। তাহল, বান্দার চোখের পানি। এই পানি আমার জন্য দিলে জাহান্নামের আগুনও নিভে যায়। রাসুলুল্লাহ ﷺ-ও হাদিসে বলেছেন,
لا يلِجُ النَّارَ رجُلٌ بَكَى مِن خشيَةِ اللَّهِ حتَّى يَعودَ اللَّبنُ في الضَّرعِ
যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। দুধ স্তনে ফিরে যাওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি তার জাহান্নামে প্রবেশ করাও অসম্ভব। (জামি’ তিরমিযী ২৩১১)
গুনাহর কারণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। আর আল্লাহর অসন্তুষ্টির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের নামই হল, জাহান্নাম। আর সেই জাহান্নাম থেকে চোখের পানির উসিলায় যদি বেঁচে যেতে পারেন, এর অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা আপনাকে হয় গুনাহটি থেকে বিশেষ রহমতে বাঁচিয়ে নিবেন কিংবা মউতের আগে হলেও এ থেকে তাওবার তাওফীক দিয়ে দিবেন।
৪ নং আমল: হাদিসে সাওবান মনে রাখবেন
ইন্টারনেটের গুনাহ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এখন যে আমল বা চিকিৎসার কথা বলবো, তা বিশেষভাবে আমাদের মত লোকদের জন্য। অর্থাৎ, যারা দৃশ্যতঃ দ্বীনদার। মা শা আল্লাহ মসজিদে আসে। তবে ফজর নামাজে আসে না। কেন? ও-ই রাতের গুনাহর কারণে। আসরের সময় ঘুমে থাকে তারপর সূর্য যখন লাল হয়ে যায়–নবীজির ভাষায় সূর্য যখন শয়তানের দু’ শিং-এর মাঝ দিয়ে উদয় হয়- তখন তড়িঘড়ি করে নামাজ পড়ে নেয়। কেন? রাতের ও-ই গুনাহর কারণে। অনুরূপভাবে মা শা আল্লাহ হয়ত দাঁড়ী আছে, টুপি আছে, পাঞ্জাবী আছে, চিল্লায় যায়, আলেমদের সোহবতে যায়, জিকিরের মজলিসে বসে কিন্তু গোপনে গোপনে গুনাহও করে। অর্থাৎ, আমি বুঝাতে চাচ্ছি, যারা বাহ্যিক সুরতে দ্বীনদার। তারা যদি একটি হাদিসের বিষয়বস্তু সব সময় মনে রাখেন, বিশেষ করে যদি গুনাহটি করার সময় মনে রাখতে পারেন তাহলে গুনাহটি করার ভূত তার ঘাড় থেকে নেমে যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে আলহামদুলিল্লাহ ফায়দা পেয়েছি। আশা করি আপনারাও পাবেন। হাদিস হুবহু মনে রাখার প্রয়োজন নেই। শুধু বিষয়বস্তুটা মনে রাখলেই চলবে। হাদিসটি এই, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
لأعلمنَّ أقوامًا من أمتي يأتون يومَ القيامةِ بحسناتٍ أمثالِ جبالِ تهامةَ بيضًا فيجعلُها اللهُ عزَّ وجلَّ هباءً منثورًا قال ثوبانُ يا رسولَ اللهِ صِفْهم لنا جَلِّهم لنا أن لا نكونَ منهم ونحنُ لا نعلمُ قال أما إنهم إخوانُكم ومن جِلدتِكم ويأخذون من الليلِ كما تأخذون ولكنَّهم أقوامٌ إذا خَلْوا بمحارمِ اللهِ انتهكُوها
আমি আমার উম্মতের কিছু লোক সম্পর্কে জানি যারা কেয়ামতের দিন তিহামা পাহাড় পরিমাণ শুভ্র নেক আমল নিয়ে হাজির হবে। (অর্থাৎ, হয়ত তাদের জীবনে নফল আছে। তাবলীগ আছে। তালীম আছে। দ্বীনের বহুমুখী খেদমত আছে।) কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদের এত বিশাল বিশাল আমলকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করে একেবারে লাপাত্তা করে দিবেন। হাদিসটির বর্ণনাকারী সাওবান রাযি.-এটা শুনে বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, তারা তোমাদেরই ভাই এবং তোমাদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত। তোমাদের যেমন রাত আসে তাদের কাছেও রাত আসে। কিন্তু তারা এমন লোক যে, নির্জনে নিভৃতে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হয়। (ইবন মাজাহ ৪২৪৫)
সুতরাং ভাবুন, এই ভার্চুয়াল গুনাহ, গোপন গুনাহ আমার আমল নষ্ট করে দিচ্ছে না তো? আমার তাবলীগ, আমার জিহাদ, আমার হজ, আমার ইতেকাফ, আমার সাদাকা অজগরের মত গিলে ফেলছে না তো?! এভাবে চিন্তা ধরে রাখতে পারলে ‘ইন শা আল্লাহ’ গুনাহটি থেকে সহজে বের হয়ে আসতে পারবেন।