ইন্টারনেট জগতের গুনাহ: ভয়াবহতা এবং বাঁচার ১২ টি আমল ও কৌশল

শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

ইন্টারনেট জগতের গুনাহ

ভয়াবহতা এবং বাঁচার ১২ টি আমল ও কৌশল

(পর্ব ০৪)

৫ নং আমল: আল্লাহ তাআলার সঙ্গ অনুভব করুন

সব সময় সর্বাবস্থায় ‘আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন’ এই কল্পনা ধরে রাখার চেষ্টা করা। তিনি আমাদের প্রতিটি কাজ দেখছেন, পর্যবেক্ষণ করছেন। ইবনুল আরাবী রহ. বলতেন,

أَخْسَرُ الْخَاسِرِينَ مَنْ أَبْدَى لِلنَّاسِ صَالِحَ أَعْمَالِهِ، وَبَارَزَ بِالْقَبِيحِ مَنْ هُوَ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ওই ব্যক্তি যে মানুষের সামনে ভালো আমল করে। কিন্তু যে মহান সত্তা তার শাহরগের চেয়েও অধিক নিকটে তাঁর সামনে গুনাহ করে। (তাবাকাতুল আওলিয়া ১/৭৭)

আর আমাদের শাহরগের চেয়েও অধিক নিকটে কে? আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ

আর আমি তার গলার শিরা থেকেও নিকটবর্তী। (সূরা ক্বাফ ১৮)

এভাবে সব সময় সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার সঙ্গ যদি ফিল করতে পারেন, অনুভব করতে পারেন তাহলে গোপন গুনাহর এই জগত থেকে বের হওয়া আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।  আল্লাহর এক আরেফ কত চমৎকার করে বলেন,

فَاستَـحْيِ مِن نَظرِ الإِلَهِ وَقُل لَـهَا — إِنَّ الَّذِي خَلَقَ الظَّلَامَ يَـرَانِـي

লজ্জা কর রবের দৃষ্টিকে। নফসকে বল, যিনি অন্ধকার সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাকে দেখেন।

এই অনুভূতিটা কীভাবে আনবেন?

উক্ত অনুভূতিটা নিজের মাঝে আনবেন কীভাবে? কীভাবে চব্বিশ ঘণ্টা এটা ধরে রাখবেন? এ লক্ষে একটা ছোট্ট আমল বলে দিচ্ছি। আমলটা অনেকটা এরকম যে, যেমন মাদরাসায় কিংবা স্কুলে উসতাদ সবক দেন। ছাত্র সবকটা পরবর্তীতে আধ ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পড়ে নেয়। তারপর উসতাদের নিকট যথারীতি সে সবকটা দিতে পারে। অনুরূপভাবে প্রত্যেক নামাযের পর দৈনিক অন্তত পাঁচ বার কিছু সময়ের জন্য- দুই থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন। মুরাকাবা এভাবে করবেন- চোখ বন্ধ করবেন। তারপর ভাববেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ অথবা এই আয়াতের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করবেন- هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ ‘তোমরা যেখানেই তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’

এভাবে নিয়মিত কিছুদিন করতে পারলে -ইনশা আল্লাহ- ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে বসে যাবে এবং ইন্টারনেটের এই ফেতনা থেকে চব্বিশ ঘণ্টার বাকি সময়গুলোতেও বেঁচে থাকতে পারবেন।

৬ নং আমল: এই চিন্তা করবেন যে, যদি আল্লাহ আমার এই গুনাহগুলো প্রকাশ করে দেন!

এই চিন্তা করবেন যে, আমি যে গোপনে পর্ণ মুভি দেখি, আমি যে ইউটিউবে হিন্দি ফ্লিম দেখি, আমি যে ফেসবুকে বিভিন্ন ফ্লিমের রিভিউ দেখি, আমি যে পরনারীর সঙ্গে চ্যাট করি–আমার এসকল গোপন কাণ্ড যদি যারা আমাকে ভালো মানুষ মনে করে সম্মান করে তারা জেনে ফেলে তাহলে আমার ইজ্জতের কেমন ফালুদা হবে!

এরপর চিন্তা করবেন, আল্লাহ তাআলার একটা অভ্যাস আছে। তিনি প্রথম প্রথম বান্দার গুনাহ গোপন রাখেন। কেন? এজন্য যে, তিনি অপেক্ষা করেন, বান্দা গুনাহ করেছে গোপনে, সুতরাং আমার কাছেও মাফ চেয়ে নিবে গোপনে। আর আমিও তাকে গোপনে মাফ করে দিব। কিন্তু এরপরেও যদি বান্দা মাফ না চায়, তাওবা না করে, উপরন্তু গুনাহটা করেই যায় তাহলে তিনি সবটা নয়; বরং গুনাহর কিছু অংশ প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে মূলত আল্লাহ বান্দাকে সতর্ক করতে চান যে, দেখো বান্দা! তুমি গুনাহ করেছিলে এক সাগর। আর আমি সেখান থেকে প্রকাশ করেছি মাত্র এক আঁজলা। গুনাহ করেছিলে এক পাহাড়। আরা বাইরে এনেছি মাত্র একটি কঙ্কর। এর পরেও তোমার ইজ্জতের কেমন ফালুদা হয়ে গেল! অথচ আমি চাইলে তো পুরাটাই প্রকাশ করে দিতে পারি। এভাবে মাঝে মাঝে চিন্তা করবেন যে, আল্লাহ যদি আমার গুনাহ প্রকাশ করে দেন! দেখবেন, এই চিন্তা আপনাকে গুনাহ থেকে কিছুটা হলেও বিরত রাখবে।

যে গুনাহগুলোর শাস্তি আল্লাহ দুনিয়াতেই দেন

তাছাড়া হাদিস শরিফে এসেছে, কিছু গুনাহ আছে এমন যেগুলোর শাস্তি আল্লাহ দুনিয়াতেই দিয়ে থাকেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

كلُّ ذنوبٍ يؤخِرُ اللهُ منها ما شاءَ إلى يومِ القيامةِ إلَّا البَغيَ وعقوقَ الوالدَينِ ، أو قطيعةَ الرَّحمِ ، يُعجِلُ لصاحبِها في الدُّنيا قبلَ المَوتِ

আল্লাহ তাআলা তার মর্যিমাফিক গুনাহসমূহের মধ্যে যে কোন গুনাহের শাস্তি প্রদান কেয়ামত পর্যন্ত বিলম্বিত করতে পারেন। কিন্তু তিনি ব্যভিচার, পিতা-মাতার অবাধ্যাচরণ ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার গুনাহর শাস্তি অপরাধীর মৃত্যুর পূর্বেই এই দুনিয়াতে দিয়ে থাকেন। (আলআদাবুল মুফরাদ ৫৯১)
আর দুনিয়াতে শাস্তি দেয়ার এটাও একটা ধরণ যে, গুনাহটি মানুষের সামনে নিয়ে আসা। যার কারণে মানুষ তাকে তিরস্কার করবে, ছি ছি করবে।

ক্লিক বা টাচ করে নগ্নতায় ডুবে যাওয়াটাও ব্যভিচার

দেখুন, উক্ত হাদিসে প্রথম যে গুনাহটির কথা বলা হয়েছে তাহল, البَغي যার প্রসিদ্ধ অর্থ হল, ব্যভিচার। আর ব্যভিচার চোখ দ্বারা হতে পারে, হাতের টাচের মাধ্যমেও হতে পারে। রিয়েল লাইফে হতে পারে, অনলাইনেও হতে পারে। গুগলে ক্লিক মেরে আপনি যে নগ্নতায় হারিয়ে গেলেন কিংবা মোবাইলে টাচ করে যে অশ্লীলতায় ডুবে গেলেন এই ক্লিক বা টাচটাও হাদিসের ভাষায় ব্যভিচার। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, اَلْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظْرُ চোখের ব্যভিচার হল দেখা। আর وَالْيَدُ زِنَاهُمَا الْبَطْشُ হাতের ব্যভিচার হল স্পর্শ করা, টাচ করা। সুতরাং ভেবে দেখুন, যদি আল্লাহ আমার অনলাইনের বিচরণের এ টু জেড লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আসেন তাহলে..?
৭ নং আমল: আল্লাহ তাআলাকে লজ্জা করতে শিখুন!
হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. কথাটা এভাবে বলেছেন, গুনাহ থেকে বাঁচার একটি কৌশল হল, এই কথা চিন্তা করা গুনাহটি আমি আমার শায়খের সামনে মা-বাবার সামনে কিংবা যারা আমাকে ভালো মানুষ মনে করে তাদের সামনে করতে পারবো কিনা! তারপর চিন্তা করো, তারা তো এখানে নেই। কিন্তু আমার আল্লাহ তো আছেন। তিনি সকলের চেয়েও বড়। সুতরাং তাঁর সামনে গুনাহটি কীভাবে করবো?!

হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ ﷺ এটাই বলেন,

استحي من الله استحياءَ رجل ذي هيبةٍ من أهلك

তুমি আল্লাহকে লজ্জা কর। যেমন তুমি তোমার পরিবারের সম্মানিত লোককে লজ্জা করে থাকো।

অপর হাদিসে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

وَأَنْ تَسْتَحِيَ مِنَ اللهِ كَمَا تَسْتَحِي رَجُلاً صَالِحًا مِنْ قَوْمِكَ

আল্লাহকে লজ্জা কর, যেমন তুমি তোমার কওমের নেক মানুষকে লজ্জা করে থাকো। (বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমান ৭৭৩৮)

আল্লাহ তাআলা যাকে দু’টি জান্নাত দিবেন

দেখুন, একটা হল, আল্লাহর সাধারণ ভয়ে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। আর আরেকটা হল, আল্লাহর বড়ত্বকে সামনে রেখে তাঁর প্রতি লজ্জা করে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যে, আমি এই গুনাহ নিয়ে আল্লাহর সামনে কীভাবে উপস্থিত হবো! প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টির দাম আল্লাহর কাছে বেশি। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে ডাবল জান্নাত দান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ

আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্য রয়েছে দু’টি উদ্যান। (সূরা আররাহমান ৪৬)

৮ নং আমল: আখেরাতের মোরাকাবা করুন

মাঝে মধ্যে আখেরাতের মোরাকাবা করবেন। অর্থাৎ, এভাবে চিন্তা করবেন যে, আজ আমি যে গুনাহগুলোতে লিপ্ত, কেয়ামতের দিন তো আল্লাহ আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবেন যে, বান্দা! এ গুনাহটা কেন করলি? দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে তুমি মনে করেছিলে যে, তোমাকে কেউ দেখে নাই। আমিও কি দেখি নাই? তুমি কি মনে করেছ যে, আমার দেখা মাখলুকের চোখের চেয়ে দুর্বল? এভাবে আল্লাহ তাআলা যখন সরাসরি প্রশ্ন করবেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ তো বলেছেন,

مَا مِنْكُم أَحَدٍ إِلَّا سَيُكَلِّمُهُ رَبُّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُ تُرْجُمَانٌ وَلَا حِجَابٌ يَحْجُبُهُ

তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সাথে তার রব কথাবার্তা বলবেন না। তার ও তার রবের মাঝে কোন দোভাষী এবং এমন কোন পর্দা থাকবে না, যা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। (সহীহ বুখারী ৬৯৩৫)

চিন্তা করুন, সে দিন তখন আমরা কী উত্তর দিবো?! সেদিন যদি আল্লাহ সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, বান্দা! রাতের দুইটা বাজে কেন তুই অশ্লীলতার ভেতর ডুবে গিয়েছিলি? কেন তুই এমন জিনিসের চর্চা করেছিলি যে, যেখানে পৌত্তলিকতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অবৈধ প্রেম ও নগ্নতাসহ কত শত অপরাধের চর্চা ও শিক্ষা ছিল? তখন আমরা কী উত্তর দিবো?!

এভাবে চিন্তা করলেও ‘ইন শা আল্লাহ’ আলোচ্য গুনাহ থেকে মুক্তি লাভ করা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।

৯ নং আমল: ভাবুন, আমার উপর পাহারাদার আছে

মাঝে মধ্যে অন্তরে এই ভাবনা জাগিয়ে তুলবেন যে, আমার উপর পাহারাদার আছে। আল্লাহ তাআলা পাহারাদার ফেরেশতার মাধ্যমে আমার ভালো-মন্দ প্রতিটি আমল সংরক্ষণ করে রাখছেন।

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. একজন কবির কাছে একটি কবিতা শুনে দরজা বন্ধ করে খুব কেঁদেছিলেন। কবিতাটি ছিল এই,

إِذَا مَا خَلَوْتَ الدَّهْرَ يَوْمًا فَلَا تَقُلْ
خَـلَـوْتُ وَلَـكِـنْ قُـلْ عَـلَـيَّ رَقِـيبُ

যদি তুমি দিনের কিছু সময় একাকী কাটাও, তখন একথা বলো না যে, আমি নির্জনে একাকী সময় কাটিয়েছি; বরং বলো, আমার পেছনে সদা সর্বদা একজন পাহারাদার ছিল।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

مَّا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ

মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে। (সূরা ক্বাফ ১৮)