ইন্টারনেট জগতের গুনাহ: ভয়াবহতা এবং বাঁচার ১২ টি আমল ও কৌশল

যে ব্যক্তি বদঅভ্যাসের বেড়াজাল থেকে বের হতে চায়, তার প্রতি নসিহত

ইন্টারনেট জগতের গুনাহ

ভয়াবহতা এবং বাঁচার ১২ টি আমল ও কৌশল

(শেষ কিস্তি। পর্ব ০৫)

১০ নং আমল: ভাবুন, নির্জনতা আল্লাহ দেন কেন?

ভাবুন, নির্জনতা আল্লাহ দেন কেন? কেন আল্লাহ তাআলার আমাদেরকে একাকীর সময়গুলো দান করেন? আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلً

আর তুমি তোমার রবের নাম স্মরণ কর এবং একাগ্রচিত্তে তাঁর প্রতি নিমগ্ন হও। (সূরা মুযাম্মিল ০৮)

সুতরাং নির্জন মুহূর্তগুলো আল্লাহ আমাদেরকে দান করেন, যেন আমরা আমাদের রবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারি। এজন্যই রাত যখন গভীর হয় তখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ডাক আসে, এই ডাক কোনো মুয়াজ্জিনের ডাক নয়; বরং এই ডাক তো আরশের মালিকের ডাক। আরশের মালিক প্রথম আসমানে নেমে আসেন আর ওই সকল বান্দাকে ডাক দেন, যারা নির্জনতার মাঝে আছে। যাদের কাছে আল্লাহর সঙ্গে প্রেম করার মত সুযোগ আছে, তাদেরকে তিনি ডাক দেন যে,

مَن يَدْعُونِي، فأسْتَجِيبَ له؟ مَن يَسْأَلُنِي فأُعْطِيَهُ؟ مَن يَستَغْفِرُني فأغْفِرَ له؟

কে আছে এমন যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিবো? কে আছে এমন যে আমার কাছে দোয়া করবে এবং আমি তার দোয়া কবুল করবো? কে আছে এমন যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে এবং আমি তাকে ক্ষমা করবো? (সহীহ বুখারী ১১৪৫)

ভোর রাতে দোয়া সব সমস্যার সমাধান

উক্ত হাদিস আমাদেরকে এই শিক্ষা দিচ্ছে যে, সব সমস্যার সমাধান ভোর রাতে দোয়া। অথচ আমরা একটু ভালো রুজির জন্য মাথার ঘাম পায়ে নিয়ে আসি। কিন্তু কয় দিন নির্জনে, রাতের গভীরে কিংবা ভোর রাতে উঠে আল্লাহ তাআলাকে ডেকেছি?!  কসম আল্লাহর! আপনি একটা চাকরির জন্য যে পরিমাণ কষ্ট দিনের বেলায় করেন, এর সামান্য অংশ যদি রাতের বেলায় উঠে আল্লাহর সঙ্গে মিটমাট করে নিতে পারতেন তাহলে চাকরি বহু আগে পেয়ে যেতেন। পেরেশানি থেকে মুক্তির জন্য যে পরিমাণ তদবির আমরা দিনের বেলায় করি এর শত ভাগের এক ভাগও যদি আল্লাহর দরবারে নির্জনে তদবীর করতাম; পেরেশানি বহু আগে গুড বাই বলে দিত।

ফুযাইল ইবন আ’য়ায রহ. এক দিন হুসাইন ইবনু যিয়াদ রহ.-এর হাত ধরে বলেন, শোনো হুসাইন!

يَنْزِلُ اللهُ تَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُولُ الرَّبُّ : كَذَبَ مَنْ ادَّعَى مَحَبَّتِي إِذَا جَنَّهُ اللَّيْلُ نَامَ عَنِّي ؟ أَلَيْسَ كُلُّ حَبِيبٍ يُحِبُّ خَلْوَةَ حَبِيبِه ؟

আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক রাতে দুনিয়ার আসমানে আসেন। তারপর বলতে থাকেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি ভালোবাসার দাবী করে অথচ রাতের গভীরে ঘুমিয়ে থাকে; সে মূলতঃ মিথ্যা দাবী করলো। প্রত্যেক প্রেমিক কি তার প্রেমাস্পদের সঙ্গে একান্ত সময় কামনা করে না! (আল হুলইয়াহ ৮/৯৯,১০০)

চিন্তা করুন, যে ঘুমিয়ে থাকে, আল্লাহ তাআলা তাকেই বলেন, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার দাবী মিথ্যা। আর আমরা তো ঘুমিয়ে থাকি না; বরং নিশাচর প্রাণীর মত জেগে থাকি। কী নিয়ে জেগে থাকি? এসব ডিভাইস সঙ্গে নিয়ে জেগে থাকি; তাহলে আল্লাহ তাআলার আমাদের ভালোবাসার দাবী কতটুকু সত্য?!

এজন্যই বলি, ভোর রাতে দোয়ার অভ্যাস করুন। আগে ভাগে ঘুমিয়ে পড়ুন তাহলে ওঠা সহজ হবে। ঘুমানোর সময় তাহাজ্জুদের নিয়ত করে নিন। তাহলে বাস্তবে রবের সঙ্গে একান্ত সময় কাটাতে না পারলেও অন্তত নিয়তের দিক থেকে হলেও তাঁর একান্ত সঙ্গ অনুভব করতে পারবেন। এটা আপনাকে বহু গুনাহ থেকে হেফাজত করবে।

১১ নং আমল: ভাবুন, আমি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাচ্ছি না তো?  

এই কথা চিন্তা করবেন যে, শয়তান আমাদের প্রধান শত্রু। আর নির্জনে গুনাহয় লিপ্ত থাকার অর্থ হল, আমি আমার নির্জনতা কাটালাম শয়তানের সঙ্গে। আর শয়তান কাউকে সঙ্গী বানিয়ে নিতে পারলে তাকে জাহান্নামে নিয়েই ছাড়বে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَن يَكُنِ ٱلشَّيْطَٰنُ لَهُۥ قَرِينًا فَسَآءَ قَرِينًا

আর শয়তান কারও সঙ্গী হলে সে সঙ্গী কত মন্দ! (সূরা নিসা ৩৮)

এ কারণেই ইবনুল কাইইয়িম রহ. বলেন,

أجمع العارفون بالله ان ذنوب الخلوات هي أصل الانتكاسات، وأن عبادات الخفاء هي أعظم أسباب الثبات

সকল আউলিয়ায়ে কেরাম একমত যে, বান্দার গোপন গুনাহ দ্বীনের পথে তার পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। আর বিপরীতে গোপন ইবাদত দ্বীনের পথে অবিচল থাকার অন্যতম উপায়। (মাউকিউ দুরারিস সুন্নিয়্যা ১/২৪৩)

মৃত্যুর সময় অশুভ পরিণতির কারণ

ইবনু রজব রহ. তো আরো কঠিন কথা বলেন,

أَنَّ خَاتِمَةَ السُّوءِ تَكُونُ بِسَبَبِ دَسِيسَةٍ بَاطِنَةٍ لِلْعَبْدِ لَا يَطَّلِعُ عَلَيْهَا النَّاسُ

মৃত্যুর সময় অশুভ পরিণতির কারণ বান্দার গোপন গুনাহ; যা সম্পর্কে মানুষ জানত না। (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম  ১/১৭২)

এবার বুঝেছেন, সালিক সুলুকের পথে অগ্রসর হতে পারে না কেন? সংশোধন-প্রত্যাশী নিজেকে সংশোধন করতে পারে না কেন? জাকির জিকিরে মজা পায় না কেন? মুনাজাতে চোখের পানি আসে না কেন? নামাজী নামাজের স্বাদ পায় না কেন?

এসবের পিছনে একটাই কারণ; গোপন গুনাহ। একটু ভাবুন, শয়তান আমাদেরকে দিয়ে গোপন গুনাহ করিয়ে কোথা থেকে কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে! আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।

১২ নং আমল: ইশা ও ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়ুন 

সকল নামাজের গুরুত্ব অবশ্যই দিবেন। কেননা, নামাজ মানুষকে সব ধরণের গুনাহ থেকে বিরত রাখে। তবে গোপন গুনাহ তথা নেট জগতের গুনাহ থেকে বাঁচার চিকিৎসা হিসেবে দুই নামাজের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। তাহল, ইশা ও ফজর নামাজ। সুতরাং সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এই দুই নামাজ যথা সময়ে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে পড়ার। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

من صلَّى العشاءَ في جماعةٍ كانَ كقيامِ نصفِ ليلةٍ ومن صلَّى العشاءَ والفجرَ في جماعةٍ كانَ كقيامِ ليلةٍ

যে ব্যক্তি ইশার নামাজ জামাতের সাথে আদায় করল সে যেন অর্ধ রাত ইবাদতে ব্যস্ত থাকল। আর যে ব্যক্তি ফজর ও ইশার নামাজ জামাতে আদায় করল সে যেন সারা রাতব্যাপী ইবাদতে মশগুল থাকল। (সুনান আবু দাউদ ৫৫৫)

সুতরাং ইশার নামাজ জামাতে আদায় করার ফজর জামাতও যেন জামাতে আদায় করতে পারেন, এর জন্য আগে আগে ঘুমানোর গুরুত্ব দিবেন। তাহলে ‘ইন শা আল্লাহ’ গুনাহটি আপনাকে আর পেয়ে বসবে না। ঘুমানোর আগে সূরা বাকারা শেষ দুই আয়াত পড়ে ঘুমাবেন। তাহলে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। ‘যথেষ্ট হয়ে যাবে’-এর অর্থ ব্যাপক। তন্মধ্যে এক অর্থ এটাও যে, শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচার জন্য এই দুই আয়াত যথেষ্ট হয়ে যাবে।

এরপরেও গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে একটি নেক আমল করে নিবেন

উল্লেখিত ১২ টি পদক্ষেপ নেয়ার পরেও গুনাহ হয়ে যেতে পারে। মাঝে মাঝে হোঁচট খেতে পাতে পারেন। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে একটি নেক আমল করে নিবেন।  বলতে পারেন, গুনাহটি হয় সাধারণত গভীর রাতে। তখন কী নেক আমল করবো? আমি বলবো, তখনই তো নেক আমল করার ব্যাপক সুযোগ। যেমন, লা ইলাহা ইল্লাহ পড়তে পারেন। আধা ঘণ্টা গুনাহ করেছেন, অন্তত পাঁচ মিনিট হলেও বলুন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।  হাদিস শরিফে এসেছে, আবু জর গিফারী রাযি. রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে আবেদন করেছিলেন,

يا رسولَ اللَّهِ علِّمني شيئًا يقرِّبُني منَ الجنَّةِ ويباعدُني منَ النَّارِ

ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে এমন কৌশল শিখিয়ে দিন, যা আমাকে জান্নাতের কাছে নিয়ে যাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দিবে।

তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে বলেছেন,

إذا عمِلتَ سيِّئةً فأتبِعها حسنةً

গুনাহ করে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে একটি নেক আমল করে নিবে।

আবু জর গিফারী রাযি. বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ!

أمنَ الحسَناتِ لا إلَه إلَّا اللَّه ؟

লা ইলাহা ইল্লাহ-ও কি নেক আমল?

রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তরে বলেছেন,

هيَ أحسَنُ الحسَناتِ

এটি তো সর্বোত্তম নেক আমল। (মুসনাদ আহমাদ ২১৫২৫)

বার বার ইসতেগফার করুন

অনুরূপভাবে গুনাহ হয়ে গেলে আরেকটি নগদ নেক আমলের নাম ইসতেগফার। সুতরাং গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ইসতেগফার করুন। বলতে পারেন, গুনাহ বার বার হয়ে যায় তাহলে ইসতেগফারও বার বার করবো? এই প্রশ্নটাই এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর নিকট করেছিল, তখন কী উত্তর দিয়েছিলেন; হাদিসটি শুনুন–

أنَّ رجلًا قالَ يا رسولَ اللَّهِ أحدُنا يُذنِبُ الذَّنبَ قالَ يُكْتبُ عليهِ قالَ ثمَّ يستغفرُ ويتوبُ قالَ يُغفَرُ لَهُ ويتابُ عليهِ قالَ ثمَّ يَعودُ فيذنبُ قالَ يُكْتبُ عليهِ قالَ ثمَّ يَستَغفرُ ويَتوبُ قالَ يُغفَرُ لَهُ ويُتابُ عليهِ ولا يملُّ اللَّهُ حتَّى تملُّوا

এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের মধ্য থেকে কোনো ব্যক্তি যদি গুনাহ করে ফেলে? রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, তাহলে গুনাহটি লিখে রাখা হয়। লোকটি বলল, যদি ওই ব্যক্তি ইসতেগফার ও তাওবা করে নেয় তাহলে? রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন,  তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং তার তাওবা কবুল করে নেয়া হয়। লোকটি পুনরায় বলল, যদি ওই ব্যক্তি আবার গুনাহ করে ফেলে? রাসুলুল্লাহ ﷺ আগের মত উত্তর দিলেন যে, তাহলে গুনাহটি লিখে রাখা হয়। লোকটি আবারও প্রশ্ন করল, যদি এবারেও ওই ব্যক্তি ইসতেগফার ও তাওবা করে নেয় তাহলে? তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং তার তাওবা কবুল করে নেয়া হয়। আর (ইসতেগফার করতে করতে) তোমরা ক্লান্ত হতে কিন্তু (ক্ষমা করার ব্যপারে) আল্লাহ তাআলা ক্লান্ত হন না।  (আল আমালি আল মুতলাকা ১৩৪)

কথা আজ একটু দীর্ঘ হয়ে গেল। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে পবিত্র জীবন দান করুন। কথাগুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন। ইন্টারনেট ব্যবহার বর্তমানে আমাদের জরুরত। জরুরত যেন গুনাহর হাতিয়ার না হয়ে সে দিকে লক্ষ রেখে এর নিয়ন্ত্রণ কারার তাওফিক দান করুন। আমীন।