দীন কিভাবে শিখবে ও শেখাবে?

শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী

অনুবাদ
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী

হামদ ও সালাতের পর!

عَنْ أَبِي قِلاَبَةَ، عَنْ أَبِي سُلَيْمَانَ، مَالِكِ بْنِ الْحُوَيْرِثِ قَالَ أَتَيْنا إلى النبيِّ ﷺ ونَحْنُ شَبَبَةٌ مُتَقارِبُونَ، فأقَمْنا عِنْدَهُ عِشْرِينَ يَوْمًا ولَيْلَةً، وكانَ رَسولُ اللَّهِ ﷺ رَحِيمًا رَفِيقًا، فَلَمَّا ظَنَّ أنَّا قَدِ اشْتَهَيْنا أهْلَنا سَأَلَنا عَمَّنْ تَرَكْنا بَعْدَنا، فأخْبَرْناهُ، قالَ: ارْجِعُوا إلى أهْلِيكُمْ، فأقِيمُوا فيهم وعَلِّمُوهُمْ ومُرُوهُمْ – وذَكَرَ أشْياءَ أحْفَظُها أوْ لا أحْفَظُها – وصَلُّوا كما رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي، فإذا حَضَرَتِ الصَّلاةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أحَدُكُمْ، ولْيَؤُمَّكُمْ أكْبَرُكُمْ ( أخرجه البخاري 631)

মালিক ইবনে হুয়াইরিস রাযি.। সাহাবী। বনুলাইছ গোত্রের সদস্য ছিলেন। মদিনা থেকে অনেক দূরে ছিল তার গোত্রের অবস্থান। আল্লাহ তাঁদেরকে ঈমান গ্রহণের তাওফিক দিয়েছিলেন। সকলেই মুসলমান হলেন। নিজেদের গ্রাম থেকে তাঁরা মদিনাতে পৌঁছলেন। সকলেই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। সাহাবী মালিক রাযি. আলোচ্য হাদিসে সেই ঘটনারই বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা সবাই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে উপস্থিত হলাম। সবাই ছিলাম তারুণ্যের তপ্ত বয়সে উপনীত। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে আমরা ২০ দিন ছিলাম। ২০ দিন পর তিনি ভাবলেন, হয়তো বাড়িতে ফেরার আগ্রহ আমাদের অন্তরে জেগেছে। তাই তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িতে তোমাদের কারা আছে? আমরা বললাম, অমুক অমুক পরিজন আছে। তিনি তো ছিলেন মানবতার নবী। মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন। আপন হৃদয়ে সকলের জন্য তিনি কোমলতা পুষতেন, তাই তিনি আমাদেরকে বললেন, তোমরা নিজেদের বাড়িতে চলে যাও। তাদেরকে দ্বীন শেখাও। দ্বীনের উপর আমল করার কথা তাদেরকে বলো। যেভাবে তোমরা আমাকে নামাজ পড়তে দেখেছো সেভাবেই তোমরা নামাজ পড়বে। নামাজের সময় হলে একজন গিয়ে আজান দেবে। তোমাদের মধ্যে যে বয়সে বড় তাকে ইমামতি করতে বলবে।
এই বলে রাসুলুল্লাহ ﷺ এদেরকে ছুটি দিয়ে দিলেন।
দীন শেখার পদ্ধতি
হাদীসটি সুদীর্ঘ। যাতে রয়েছে আমাদের জন্য বহুবিধ শিক্ষা। মালিক ইবনে হুয়াইরিস রাযি. প্রথম যে কথাটি বলেছেন তা হল, আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে যখন এসেছি তখন সবাই ছিলাম সমবয়সী ও তরুণ, সেখানে আমরা বিশ দিন অবস্থান করেছি। মূলত এটাই দ্বীন শেখার পদ্ধতি। ওই যুগে নিয়মতান্ত্রিক কোন মাদরাসা ছিল না। কলেজ বা ইউনিভার্সিটি হচ্ছিল না। এমনকি কোন কিতাবও ছিল না। তাই দীন শিখার একটাই তরিকা ছিল। তা হল, যে ব্যক্তি দ্বীন শিখতে চাইতেন, সরাসরি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সোহবতে চলে আসতেন। এখানে এসে রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে দেখতেন যে, তিনি কিভাবে জীবন যাপন করেন? সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর কর্মসূচি কী? লোকজনের সঙ্গে তিনি কেমন আচরণ করেন? ঘরোয়া জীবন তিনি কিভাবে কাটান? বাইরের লোকজনের সঙ্গে চলাফেরা তিনি কীভাবে করেন? এসব বিষয়গুলো তাঁরা নিজ চোখে দেখেছেন এবং নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন এবং এভাবেই তারা দীন শিখেছেন।
সোহবতের পরিচয়
‘সোহবত’ দীন শেখার মৌলিক ধারা। এর কারণ হলো, বই ও বিদ্যালয় থেকে দীন তারা শিখতে পারে যারা পড়ালেখা জানে। তাছাড়া শুধু বই কিতাব দ্বারা পরিপূর্ণ দ্বীন শেখা সম্ভবও নয়। আল্লাহ তা’আলা মানব স্বভাবে এই বিষয়টি দিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ শুধু বই পড়ে কোন বিদ্যা অর্জন করতে পারে না। জাগতিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথা।
চিকিৎসক হতে হলে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে থাকতে হয়। ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার এর কাছে সময় দিতে হয়। এমনকি পাচক হতে চাইলে একজন অভিজ্ঞ বাবুর্চির কাছে সময় কাটাতে হয়। এরই নাম সোহবত। অর্থাৎ, বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ও দক্ষ যারা তাদের সংস্পর্শে থাকা।
সাহাবায়েকেরাম এভাবেই দীন শিখেছেন। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা সকল আসমানী কিতাবের সাথে রাসুলও পাঠিয়েছেন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে মানুষের কাছে নবী-রাসূল না পাঠিয়ে সরাসরি কিতাব পাঠাতে পারতেন। এমনটি কেন করেননি? বরং তিনি কিতাবের সাথে রাসূলও পাঠিয়েছেন। যেন রাসুল ওই কিতাবের ওপর আমল করে মানুষকে সরাসরি কিতাবের উপর কিভাবে আমল করতে হবে তা বুঝিয়ে দিতে পারেন। আর এভাবে মানবজাতি যেন ওই রাসুলের সংস্পর্শে থেকে আল্লাহর কিতাবের ওপর আমল করার তরিকা জানতে পারে।
সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করুন। তাঁরা কোন ভার্সিটির ছাত্র ছিলেন? কোন মাদরাসা থেকে তাঁরা ফারেগ হয়েছিলেন? কোন কিতাবগুলো তাঁরা পড়েছিলেন? সত্য কথা হল, তাঁদের জন্য বাহ্যিক কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। নির্দিষ্ট কোন কোর্স-সিলেবাস ছিল না। কিতাব ও বইপত্রও ছিল না। কিন্তু একজন সাহাবীর আমলী জীবনের সামনে হাজারো প্রতিষ্ঠান কিছুই নয়। কেননা তাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সোহবত লাভে ধন্য হয়েছিলেন। প্রতিটা আমল সরাসরি রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁদেরকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর তাঁরা ওই আমলটি নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার পূর্ণ চেষ্টা করেছিলেন। এভাবেই তাঁরা সাহাবী হয়েছিলেন।
ভালো সোহবত গ্রহণ কর
সোহবত মানুষকে অনেক দামি বানাতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখবে তুমি কার সোহবত গ্রহণ করছো। দীন শিখতে হলে সোহবতকে সহীহ করতে হবে অবশ্যই। এমন লোকের কাছে যেতে হবে, এমন লোকের সঙ্গে চলাফেরা করতে হবে যিনি প্রকৃতপক্ষেই দীনের ধারক-বাহক। এতে দীনের ওপর আমল করার যোগ্যতা তৈরি হবে। দীনের প্রতি আজমত ও মহব্বত বৃদ্ধি পাবে। পক্ষান্তরে সোহবত যদি হয় ভ্রান্তলোকের তাহলে সে তোমাকেও অভ্রান্ত করে ছাড়বে। এই দীন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জামানা থেকে এভাবেই চলে আসছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সোহবতে সাহাবায়ে কেরাম তৈরি হয়েছেন। সাহাবাদের সোহবতে তাবিঈগণ তৈরি হয়েছেন। তাবিঈগণের সোহতে তৈরি হয়েছেন তাবেতাবিঈনের জামাত। এ ধারাবাহিকতায়ই দীন আমাদের পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।
দুই সিলসিলা
আব্বাজান মুফতী শফী রহ. তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনে লিখেছেন, আল্লাহ তা’আলা মানবজাতির হেদায়েতের জন্য দুটি সিলসিলা দান করেছেন। ১. কিতাবুল্লাহর সিলসিলা। ২. রিজালুল্লাহর সিলসিলা। অর্থাৎ, কিতাবুল্লাহর পাশাপাশি এমন সব মনীষীও আল্লাহ প্রেরণ করেছেন, যারা কিতাবুল্লাহর ওপর আমল করে দেখিয়েছেন। সুতরাং দীন চলবে এই দুই ধারার মাধ্যমেই। এছাড়া দীন চলবে না। দীনের হাকিকত এই দুই ধারা ছাড়া বোঝা অসম্ভব। সুতরাং কেউ যদি রিজালুল্লাহকে উপেক্ষা করে শুধু কিতাবুল্লাহ নিয়েই মেতে থাকে তাহলে সে যেমনিভাবে পথহারা হতে বাধ্য, অনুরূপভাবে যে কিতাবুল্লাহ উপেক্ষা করে শুধু রিজালুল্লাহকে সব কিছু মনে করে তারাও পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য।
এই জন্যই আমাদের বুজুর্গগণ বলেছেন , এই সময়ে দীন শিখার ও দীনের ওপর আমল করার সহজ উপায় হল, আল্লাহওয়ালাদের সংস্পর্শ নিতে হবে। এমন লোকের সোহবত গ্রহণ করতে হবে যারা দীন বোঝেন এবং নিজেও দীনের উপর আমল করেন। যে ব্যক্তি যত বেশি সোহবত নিতে পারবে সে দীনের ব্যাপারে তত বেশি উন্নতি সাধন করতে পারবে।
যাই হোক, আলোচ্য হাদিসে এমন কিছু সাহাবায়ে কেরামের বিবরণ এসেছে যারা দূরের বাসিন্দা হওয়ার কারণে রাসুলুল্লাহ এর সাথে নিয়মিত থাকতে পারতেন না। তাই তাঁরা এই সোহবত লাভের জন্য বিশ দিন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে অবস্থান করলেন। এই বিশ দিনে দীনের মৌলিক বিষয়গুলো তাঁরা রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে শিখে নিলেন।
ছোটদের প্রতি লক্ষ্য রাখা
তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মনে হলো এরা তো যুবক; নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে এসেছে সুতরাং এদের অন্তরে বাড়িঘরের চিন্তা হয়তো আনাগোনা করছে। ঘরের মানুষদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করার ইচ্ছা হয়তো এদের অন্তরে জেগেছে। তাই রাসুলুল্লাহ ﷺ এদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা বাড়ি-ঘরে কাকে রেখে এসেছ? এদের মধ্যে কিছু যুবক ছিল নববিবাহিত। তাই রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন জানতে পারলেন, তারা বাড়িতে কাকে রেখে এসেছে, তখন বললেন, এবার তোমরা নিজেদের বাড়িঘরে চলে যাও।
বাড়িঘর থেকে দূরে থাকার মূলনীতি
আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, বিবাহিত ব্যক্তি বিনা কারণে বাড়িঘর থেকে দূরে বেশিদিন থাকা উচিত নয়। এতে যেমন নিজের হেফাজত রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাড়িঘরে যারা আছে তাদের হেফাজতও। কেননা, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে দীন দান করেছেন, এতে রয়েছে জীবনের সব বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান। দীন আমাদেরকে প্রান্তিকতার পথ অবলম্বন করতে বলে না। এক দিকে ঝুঁকে পড়ার শিক্ষা আমাদেরকে দেয় না। এজন্যই আমরা أُمَّةً وَسَطًا তথা মধ্যপন্থী জাতি। দেখুন, আলোচ্য হাদিসেও এই শিক্ষা রয়েছে। আলোচ্য হাদীসে একদিকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সোহবতের গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে, অপরদিকে পরিবারের গুরুত্বও স্থান পেয়েছে। তাই রাসুলুল্লাহ ﷺ বিশ দিন পর এদেরকে বললেন, এবার তোমরা বাড়ি যাও এবং পরিবারের হক পূরণ কর।
অন্যান্য হক আদায়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ
মাত্র বিশ দিনে দীনের সব কিছু শেখা সম্ভব নয়। সুতরাং এসব সাহাবা যে দীনের সব কিছু এই বিশ দিনে শিখতে পারেন নি; এতে কোন সন্দেহ নেই। রসুলুল্লাহ ﷺ ইচ্ছা করলে এদেরকে বলতে পারতেন, আরো কিছু কুরবানি পেশ করো, এখনই বাড়িঘরে না গিয়ে আরো কিছুদিন আমার কাছে থাকো এবং আরো কিছু শিখে নাও। কিন্তু রাসুলুল্লাহ ﷺ একথা বলেন নি; বরং তিনি যখন দেখলেন, দীনের মৌলিক বিষয়গুলো এরা শিখে নিয়েছে তাই তিনি এদেরকে ছুটি দিয়ে দিলেন।
দীন শেখা ফরজে আইন যতটুকু
এ প্রসঙ্গে বুঝে নিতে হবে যে, দীনি ইলম দুই প্রকার। প্রথম প্রকারে রয়েছে ঐ সমস্ত বিষয় যেগুলো পালন করা ফরজ বা ওয়াজিব। যেমন, নামাজ কিভাবে পড়তে হয়? কোন নামাজ কত রাকাত? নামাজের ফরজ ও ওয়াজিব কতটি? রোজা কিভাবে রাখতে হয় এবং কখন ফরজ হয়? হজ কখন ফরজ হয়? যাকাত কখন ফরজ হয় এবং কাদেরকে দিতে হয়? কোন জিনিস হালাল এবং কোনটি হারাম? যেমন মিথ্যা বলা হারাম, গীবত করা হারাম, মদ পান করা হারাম, শূকর খাওয়া হারাম। হালাল-হারাম সংক্রান্ত এসব মৌলিক কথা জানা এবং দীনের ফরজ-ওয়াজিবগুলো জানা পুরুষ কিংবা নারী প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজে আইন। এই মর্মে হাদীস শরীফে এসেছে,
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ومسلمة
দীনি ইলম শেখা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ।
এতটুকু ইলম অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনে মা-বাবা-ভাই-বোন স্ত্রী-সন্তানকে বাড়িঘরে রেখে হলেও এইটুকু ইলম শিক্ষার জন্য বের হয়ে যেতে হবে। এতটুকু ইলমের পথে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে তার পরোয়া করা যাবে না।
ফরজে কেফায়া কতটুকু?
পক্ষান্তরে দ্বিতীয় প্রকারের দীনি ইলম হল, দীনের ব্যাপারে বিস্তারিত জানা। এটা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজে আইন নয়। কিছু লোক আলেম হলে অন্যান্যদের পক্ষ থেকেও এ ফরজ আদায় হয়ে যাবে। যেমন, এক গ্রামে যদি একজন আলেম থাকে তাহলে অন্যান্য লোকের পক্ষ থেকে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। যদি কোনো বড় শহরে এই পরিমাণে আলেম থাকে যে, তাঁদের মাধ্যমে দীনের মাসআলা ও সমাধানের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয় তাহলে ওই শহরের সকল বাসিন্দার পক্ষ থেকে এই ফরজ আদায় হয়ে যাবে।
ঘরওয়ালাদেরকে দীন শিক্ষা দাও
উক্ত যুবক সাহাবাগণ যখন দীনের ফরয ইলম শিখে নিয়েছেন তাই রাসুলুল্লাহ তাদেরকে বাড়িঘরে যাবার অনুমতি দিয়ে দিলেন। তবে পাশাপাশি এ ব্যাপারেও সতর্ক করে দিলেন যে, বাড়িঘরে গিয়ে গাফেল হয়ে যেও না; বরং এখান থেকে যে ইলম তোমরা নিয়ে যাচ্ছ তা ঘরওয়ালাদেরকেও শিক্ষা দিবে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হল, এটাও একজন মুসলমানের দায়িত্ব যে, সে নিজে যতটুকু জানে ততটুকু ঘরওয়ালাদেরকেও জানাতে হবে। ঘরওয়ালাদেরকে কমপক্ষে এতটুকু দীন শিখাতে হবে যাতে তারা মুসলমানের যিন্দেগী যাপন করতে পারে। যেমন, নামাজ রোজা হজ ও জাকাতের ইলম তাদেরকে শিখাতে হবে।
সন্তানের ব্যাপারে উদাসীনতা
সন্তানের ব্যাপার উদাসীনতা আমাদের সমাজে ব্যাপক। বিশেষ বিশেষ পরিবেশেও এই উদাসীনতা দেখা যায়। নিজে খুব দীনদার অথচ সন্তানকে দিন শেখানোর ফিকির করে না। এমনকি কোরআন মজিদ ও নামায শিক্ষা থেকেও সন্তানকে বঞ্চিত রাখে। সন্তানকে জাগতিক শিক্ষায় উচ্চতর করে তোলে আর দীনের ব্যাপারে তাকে মূর্খ রাখে। এজন্যই বলি সন্তানদেরকে দীন শেখাতে হবে। কমপক্ষে যতটুকু ইলম একজন মুসলমানের জীবনে প্রয়োজন হয় ততটুকু শিখাতে হবে।
নামাজ পড়বে কিভাবে?
তারপর রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,
صَلُّوا كما رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي
বাড়িঘরে গিয়ে তোমরা নামাজ পড়বে আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছ। দেখুন, রাসুলুল্লাহ ﷺ শুধু নামাজ পড়ার কথা বলেন নি। বরং নামাজ তাঁর সুন্নত মোতাবেক পড়ার জন্য বলেছেন। কেননা নামাজ এ দীনের একটি বুনিয়াদ। সুতরাং মাথা থেকে বোঝা ফেললাম টাইপের নামাজ যেন না হয়। বরং কিয়াম কেরাত রুকু সিজদা ও বৈঠকসহ সব যেন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সুন্নত মোতাবেক হয়। বর্তমানে এই বিষয়ের প্রতিও খুব গুরুত্ব দেওয়ার তীব্র প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
নামাজ সুন্নত মোতাবেক পড়ুন
সুন্নতের প্রতি খেয়াল রেখে নামাজ পড়লে সময় যতটুকু যাবে এবং কষ্ট যতটুকু হবে ততটুকু সময় ও কষ্ট উদাসীনতার সাথে নামাজ পড়লেও যাবে। তবে পার্থক্য হলো, সুন্নত মোতাবেক নামাজ পড়লে সুন্নতের নূর ও বরকত পাওয়া যাবে। পক্ষান্তরে সুন্নতমুক্ত নামাজে এই নূর ও বরকত পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ, নামাজ আদায় হয়ে যাবে কবে তা নূর ও বরকতমুক্ত নামাজ হবে।
নামাজ দুরস্ত করার প্রতি মুফতিয়ে আজম রহ.-এর গুরুত্ব
আব্বাজান মুফতী শফী রহ. তিরাশি বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। শিশুকাল থেকেই দীনি পরিবেশে ছিলেন। সারা জীবন দীন শিক্ষা দিয়েছেন। ফতওয়া লিখেছেন। এমনকি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতি আজম তথা প্রধান মুফতিও হয়েছেন। লাখেরও অধিক ফতওয়া তিনি মৌখিক ও লিখিত আকারে দিয়েছেন। একবার তিনি বলেন, আমার জীবনটা ফিকাহশাস্ত্রের পেছনে কেটেছে। কিন্তু নামায পড়াকালে এখনো আমি এই সন্দেহের মাঝে পড়ে যাই যে, এখন কী করবো। তারপর নামাজ শেষে আমাকে কিতাব দেখতে হয় যে, আমার নামাজ ঠিক হল কিনা? অথচ আমি অনেক লোককে দেখি তার নামায শুদ্ধ হল কিনা এ ব্যাপারে কোনও লক্ষ্য নেই। নামাজ সুন্নত মোতাবেক হলো কিনা; এ চিন্তা করার কথা তো তারা ভাবেই না।
নামাজ ফাসেদ হয়ে যাবে
নামাজের কাতারে সব সময় দেখা যায় মানুষ নামাজ পড়ছে আর হাত এদিক সেদিক নাড়াচাড়া করছে। কেউবা চেহারায় হাত বুলাচ্ছে কেউবা কাপড় নিয়ে খেলা করছে। মনে রাখবেন, এভাবে যদি তিন তাসবীহ পরিমাণ সময় কেটে যায় অর্থাৎ এত পরিমাণ সময় যাতে তিনবার বলা যায় তাহলে তার নামাজ ফাসেদ হয়ে যাবে। তার নামাজের ফরজটাই অনাদায়ী থেকে যাবে। অনুরূপভাবে নামাজে যদি এমন কাজ করা হয় যাতে কারো মনে সংশয় দেখা দিতে পারে যে, এ ব্যক্তি নামায পড়ছে কিনা, তাহলে তার নামায ভেঙ্গে যাবে। অনুরূপভাবে অনেকে সিজদা দেয় তবে পা দুটি মাটি থেকে আলাদা করে রাখে। অথচ পুরা সিজদাতে যদি মাটিতে পা একবারও না লাগে তাহলে তার নামায হবে না। অথচ এসবই আমাদের সমাজের মুসুল্লিরা বেপরোয়াভাবে করে থাকে।
শুদ্ধ নিয়ত শুদ্ধ হওয়াই যথেষ্ট নয়
এই কয়েকটি কথা দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করলাম। এই বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। নামাজ পড়লাম অথচ সহিহ হলো না তাহলে সব মেহনতই তো গোল্লায় গেল। বর্তমানে তো এসব কথা বললেও দোষ। তখন অনেকে রেডিমেড উত্তর দিয়ে দেয় যে ভাই হাদীস শরীফে এসেছে, إِنَّمَاالأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর আমাদের নিয়ত তো ঠিক আছে। মনে রাখবেন, শুধু নিয়ত যথেষ্ট নয়। যদি শুধু নিয়ত যথেষ্ট হতো তাহলে ঘরে বসে মনে মনে নামাজ পড়ি নিলেই তো হতো। আপনি নিয়ত করেছেন লাহোর যাবেন কিন্তু উঠে বসেছেন কোয়েটার ট্রেনে তাহলে লাহোর কি যেতে পারবেন! পারবেন না। সুতরাং বুঝা গেল, শুধু নিয়ত যথেষ্ট নয়। নিয়তের পাশাপাশি আমলও জরুরি। রাসূলুল্লাহ এর তরিকার নামই তো হল আমল। সুতরাং নামাজ পড়তে হবে সেভাবে যেভাবে রাসুলুল্লাহ ﷺ পড়েছেন।
আযানের গুরুত্ব
আলোচ্য হাদিসে তারপর রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,
فإذا حَضَرَتِ الصَّلاةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أحَدُكُمْ
অর্থাৎ, যখন নামাযের সময় হবে তখন তোমাদের মধ্য থেকে একজন আযান দিবে।
আযান দেওয়া সুন্নত। মনে করুন কেউ যদি মসজিদে নামাজ না পড়ে কোন কারণে ময়দানে বা বনে নামাজ পড়ে তখনও আযান দেওয়া সুন্নত। এমনকি একাকী নামাজের সময়ও আজান সুন্নত। কেননা আজান আল্লাহর দীনের একটি প্রতীক ও আলামত। কোন কোন আলেমের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ময়দানে বা জঙ্গলে আযান দেওয়ার মাঝে কী একমত? কিংবা যেখানে শোনার কেউ নেই সেখানে? আলেমরা এর উত্তর দিয়েছেন, আল্লাহর সৃষ্টি অগণিত। তোমার আযান মানুষ হয়তো শুনে না তবে হতে পারে ফেরেশতা কিংবা জ্বীনরা তোমার আজান শুনবে এবং তোমার সঙ্গে নামাজে শরিক হবে।
সারকথা হলো, নামাজের পূর্বে আযান দেওয়া সুন্নত এমনকি একাকী হলেও।
বড়কে ইমাম বানাবে
তারপর তিনি বলেন, ولْيَؤُمَّكُمْ أكْبَرُكُمْ অর্থাৎ, তোমাদের মধ্য থেকে যিনি বয়সের দিক থেকে বড় হবেন তিনি ইমামতি করবেন। মূল বিধান হলো এরকম–জামাতের সময় যদি অনেক লোক থাকে তাহলে যিনি এদের মধ্য থেকে বড় আলেম তিনি ইমামতি করবেন। আর আলোচ্য ক্ষেত্রে যেহেতু এরা সকলেই ইলমের দিক থেকে সমান ছিলেন, সবাই দল বেঁধে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর খেদমতে এসেছিলেন, সবাই একই ইলম রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে উক্ত নির্দেশ দিয়েছেন।
বড়কে সম্মান করা
হাদীস শরীফে এসেছে, একবার ইহুদিদের জনপদ খায়বরে ইহুদীরা এক মুসলমানকে শহীদ করে দিয়েছিল। যিনি নিহত হয়েছিলেন, তাঁর এক ভাই ছিল। যে ভাই নিহত মুসলমানের অভিভাবক ছিল এবং উত্তরাধিকারীও ছিল। সে ভাই নিজের চাচাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর খেদমতে এটা বলার জন্য আসলো যে, আমাদের ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। এখন এর প্রতিশোধ নিবো কিভাবে? এরা দু’জন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর খেদমতে আসার পর সর্বপ্রথম নিহত ব্যক্তির ভাই কথা শুরু করলো, চাচা চুপ ছিল। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এ ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, كبر الكبر বড়কে বড়’র মর্যাদা দাও। অর্থাৎ, তোমার চাচা উপস্থিত থাকাকালীন তুমি কথা বলো না। কেননা এটা শিষ্টাচার নয়। সুতরাং তিনি আগে বলুক। প্রয়োজন হলে তুমি মাঝখানে বলতে পারবে। বুঝা গেল, বড়কে সম্মান দিতে হয়। স্থায়ী আলোচ্য হাদীসেও এসব সাহাবীকে উদ্দেশ্য করে রাসুলুল্লাহ বললেন, যিনি বয়সে বড় হবেন তাকে তোমরা ইমামতি করতে দিবে।
আল্লাহ আমাদেরকে এসব কথার উপর আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ