শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
কবরকে ঘিরে কিছু ভুল বিশ্বাস, কুসংস্কার আমাদের সমাজে আছে। পৃথিবীর প্রায় অঞ্চলে এই কুসংস্কারগুলো নানাভাবে নানা পদ্ধতিতে মানুষ লালন করে।
সেই ভুল বিশ্বাসগুলো কী এবং এগুলোর প্রতিকার কিভাবে সম্ভব__এ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা হল।
১. অনেকের মনে প্রশ্ন হিন্দুদেরকে তো কবর দেওয়া হয় না বরং তাদেরকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। সুতরাং তাদের জন্য কবরের আজাব কিভাবে হবে?
আসলে কবরের সুখ বা শাস্তির বিষয়টি সম্পূর্ণ অদৃশ্যের বিষয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান কিংবা যুক্তি দিয়ে পরিপূর্ণভাবে তা বোধগম্য করা প্রায় অসম্ভব। অদৃশ্যের বিষয়ে ঈমান আনা একজন মুমিনের জন্য আবশ্যক। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
ٱلَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِٱلْغَيْبِ
‘মুত্তাকি তারাই যারা অদৃশ্যের বিষয়গুলোতে ঈমান আনে, পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে।’ (সূরা বাকারা ০৩)
আর কবরের জীবন মানে মূলত বারযাখী জীবন। অর্থাৎ দুনিয়া এবং আখেরাতের মধ্যবর্তী একটি অন্তর্বর্তীকালীন জীবন। মারা যাওয়ার পর মানুষ কবরস্থ হোক কিংবা না হোক সঙ্গে সঙ্গে সে বারযাখী জীবনে প্রবেশ করে। কেয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত সে সেখানেই অবস্থান করবে। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَمِن وَرَائِهِم بَرْزَخٌ إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ
‘মৃত্যুর পর তাদের সামনে রয়েছে বারযাখ কেয়ামত পর্যন্ত তথা পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।’ (সূরা মুমিনূন ১০০)
সুতরাং পুড়িয়ে দেওয়া হোক পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হোক কিংবা কবরস্থ করা হোক একজন মানুষ সর্বাবস্থায় বারযাখী জীবনে পদার্পণ করতেই হবে। সর্বাবস্থায় তার আত্মা ওই শাস্তিই ভোগ করবে , যা কবরে ভোগ করার কথা ছিল।
২. সমাজে একটি ব্যাপক কু-প্রথা হল, কোন ব্যক্তি মারা গেলে এবং তাকে কবর দিতে গেলে তার আত্মীয় স্বজনেরা বিশেষত মহিলারা বুক চাপড়িয়ে, করুণ সুরে বিভিন্ন গীত গেয়ে গেয়ে আহাজারী করে। অথচ শরীয়তে এটি শক্তভাবে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
ليس مِنَّا من ضرب الْخُدُودَ، وشَقَّ الْجُيُوبَ، ودعا بِدَعْوَى الجاهلية
‘পেশিতে আঘাত করে, কাপড় ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে এবং জাহেলিয়াত যুগের মত বিভিন্ন প্রবাদ বলে যে আহাজারি করল_ সে আমার আমাদের মধ্য থেকে নয়।’ (বুখারী ১২৩৫)
সুতরাং প্রিয়জন মারা গেলে ব্যথিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করা উচিত। আর ধৈর্য ধারণ করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে যদি চোখের পানি চলে আসে কিংবা কান্নার মৃদু মৃদু আওয়াজ বের হয়ে যায় তাহলে এটা দোষণীয় নয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন,
ما لِعَبْدِي المُؤْمِنِ عِندِي جَزاءٌ، إذا قَبَضْتُ صَفِيَّهُ مِن أهْلِ الدُّنْيا ثُمَّ احْتَسَبَهُ، إلَّا الجَنَّةُ
‘প্রিয়জন মারা গেলে যে বান্দা আমার সন্তুষ্টি অর্জনকল্পে ধৈর্য ধারণ করে তাকে আমার পক্ষ থেকে জান্নাত পুরস্কৃত করা হবে।’ (বুখারী ৬০৬০)
৩. সমাজের আরেকটি জঘন্য কুসংস্কার হলো, কবর থেকে বা কবরের মাটি থেকে কিংবা কবরস্থ মৃত্যু ব্যক্তি থেকে উপকৃত হওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কবর জিয়ারতের জন্য ভ্রমণ করা। যেমন খাজা মইনুদ্দিন চিশতী রহ. শাহজালাল ইয়ামানি রহ. এর মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মানুষ ভ্রমণ করে থাকে। অথচ এজাতীয় ভ্রমণের ব্যাপারে কোরআন-সুন্নাহয় কিংবা সালফে সালেহীন থেকে কিছুই বর্ণিত হয়নি।
বরং রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
لَا تُشَدُّ اَلرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ: اَلْمَسْجِدِ اَلْحَرَامِ, وَمَسْجِدِي هَذَا, وَالْمَسْجِدِ اَلْأَقْصَى
‘ইবাদতের উদ্দেশ্যে শুধু তিটি জায়গায় ভ্রমণ করা যাবে– মক্কার মসজিদ, আমার মসজিদ এবং মসজিদে আকসা তথা বাইতুল মাকদিস।’ (বুখারী ১১৩২)
৪. সমাজে আরেকটি জঘন্য কুসংস্কার হলো, কফিনে, খাটে অথবা কবরে ফুল দেয়া। এটি কাফির-মুশরিকদের ধর্মের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
‘ব্যক্তির কার্যকলাপ যে জাতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।'(আবু দাউদ ৪০৩৩)
অনুরূপভাবে কবরস্থ ব্যক্তির জন্য নীরবতা পালন করে শোক প্রকাশ করা। এটিও একটি জঘন্যতর বিদআত। অমুসলিমদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ কাজ।
৫. আরো জঘন্য ব্যাপার হল, কবরস্থ ব্যক্তির স্মরণে বাসায় দোকানে অফিসে কিংবা অন্য কোন স্থানে ছবি টাঙ্গানো এবং তার স্মরণে কিংবা সম্মানে মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণ করা। অথচ এই মর্মে কোরআন ও সুন্নাহর বহু স্থানে স্পষ্টভাবে এবং অত্যন্ত জোরালো পদ্ধতিতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি রাসূলুল্লাহ ﷺ আলী রাযি.-কে বলেছেন,
أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلَّا طَمَسْتَهُ ، وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ
‘কোন ছবি মূর্তি ভাস্কর্য পেলে তা মিটিয়ে ফেলবে, কোন কিছু কবর পেলে তা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে।’ (মুসলিম ৯৬৯)
৬. কবরে আযান দেওয়া। রাসূলুল্লাহ ﷺ বা তাঁর কোন সাহাবী থেকে এ ধরনের কার্যকলাপ বর্ণিত নয় বিধায় এটিও সমাজে প্রচলিত একটি বিদআত।
৭. কফিনে ভরে দাফন করা। এটিও কবরকেন্দ্রিক একটি কুসংস্কার। সুন্নাহপদ্ধতি হলো, কাফনের কাপড় আবৃত করে বিনা কফিনে মৃত ব্যক্তিকে কবর দিবে।
৮. কোন মানুষ যদি শরীয়তসম্মত পন্থায় ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোনো নেক আমল করে তবে সমস্যা নেই। যেমন মৃত ব্যক্তি তথা কবরবাসীর জন্য দোয়া করা, হজ করা, ওমরাহ করা, সাদাকা করা, কুরবানী করা ইত্যাদি। অথচ সমাজে প্রচলিত একটি বিদআত হল, টাকার বিনিময়ে কোরআন পড়িয়ে ইসালে সওয়াব করা কিংবা টাকার বিনিময়ে দোয়া করা; যার কোনো ভিত্তি ইসলামী শরীয়তে নেই।
৯. কিছু কিছু জায়গায় দেখা যায়, কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ এটাও শরীয়তে স্পষ্ট নিষেধ। যেমন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
أَلاَ وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلاَ فَلاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ
‘শুনে রাখ, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবী ও সালেহীনের কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়ে ফেলত। কখনোই কোনো কবরকে তোমরা মসজিদ বানিও না। এই কাজ থেকে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি।’ (মুসলিম ২২৮৯)
১০. সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার হল, কিছু কবরপূজারী আছে যারা পীর-আউলিয়াদের কবরকে তাওয়াফ করে, কবরে বাতি জ্বালায়, লাল শালুতে মাথা ঠেকিয়ে পড়ে থাকে, কবরকে সিজদা করে, কবরের সামনে মিনতিভরে দাঁড়ায়, নিজের উদ্দেশ্য ও অভাবের কথা তুলে ধরে; সুস্থতা কামনা করে, সন্তান চায় অথবা প্রয়োজনাদি পূরণ কামনা করে। অনেক সময় কবরে শায়িত ব্যক্তিকে ডেকে বলে, বাবা হুযূর, আমি আপনার হুযূরে অনেক দূর থেকে হাযির হয়েছি। কাজেই আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না। এগুলো স্পষ্ট শিরক। কেননা আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُوْ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَنْ لاَّ يَسْتَجِيْبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُوْنَ
‘তাদের থেকে অধিকতর দিকভ্রান্ত আর কে আছে, যারা আল্লাহ ব্যতীত এমন সব উপাস্যকে ডাকে যারা ক্বিয়ামত পর্যন্তও তাদের ডাকে সাড়া দেবে না। অধিকন্তু তারা ওদের ডাকাডাকি সম্বন্ধে কোন খবর রাখে না।’ (আহক্বাফ ৫)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللهِ نِدًّا دَخَلَ النَّارَ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে তার সমকক্ষ বা অংশীদার মনে করে তার নিকট দোআ প্রার্থনা করে, আর ঐ অবস্থায় মারা যায় সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (বুখারী ৪৪৯৭)
আল্লাহ তাআলা সকলকে সহিহ বুঝ দান করুন। আমিন।