সাক্ষাৎকার ০২

সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের ইসলাম বেইজড জনপ্রিয় পোর্টাল আওয়ারইসলাম২৪.কম-এ প্রকাশিত হয়েছে। নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হল–

দু’বছর পর এবারের ইতিকাফে কতটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরবে মসজিদগুলোতে?

দু’বছর পর কোন রকম বিধি-নিষেধ ছাড়া স্বাভাবিক রমজান পালন করছেন পুরো বিশ্বের মুসলমানরা। রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল ইতিকাফেও এবার স্বতঃস্ফুর্ত  অংশ  গ্রহণে নেই কোন বাধা। রমজানের শেষ দশকের এই আমল নিয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন রাজধানী ঢাকার মাদরাসা দারুর রাশাদের সিনিয়র মুহাদ্দিস ও বায়তুল ফালাহ জামে মসজিদ, মধ্যমনিপুর, মিরপুরের খতিব মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রতিবেদক নুরুদ্দীন তাসলিম

ইতিকাফের বিধান-প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?

ইতিকাফ মুলত তাদের জন্য যারা হৃদয়ের গভীরে আল্লাহর সঙ্গে সম্বন্ধের যোগসূত্র মুঠোয় পেতে আগ্রহী। রমজানের শেষ ১০ দিন দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে একান্ত আল্লাহর হয়ে যাওয়ার জন্যই ইতেকাফ।

রমজানের শেষ দশকের এই ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা কেফায়া। যার কারণে ফকিহগণ বলে থাকেন, যদি কোনো মসজিদে একজনও ইতেকাফ না করেন তাহলে এলাকার সবাই গুনাহগার হবে।

এক হাদিসে নবীজি সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করে আল্লাহ্‌ তার মাঝে ও জাহান্নামের আগুনের মাঝে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন; যা পূর্ব-পশ্চিমের চেয়েও বেশি দূরত্ব।

এবার ভেবে দেখুন, দশ দিনের ইতিকাফ একজন মানুষকে জাহান্নামের বিভীষিকা থেকে কী পরিমাণ দূরত্বে এবং জান্নাতের স্নিগ্ধতার কতটা কাছে নিয়ে যাবে!

বাস্তবেও আমরা দেখতে পাই, ইতিকাফের ইতিবাচক ফলাফল মানুষের জীবনে তাৎক্ষণিকভাবে ইতিকাফের দিনগুলোতেই পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া পরবর্তী রমজান পর্যন্ত অনাগত দিনগুলোর উপরেও এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়।

এ সুবাদে আমি একটা বিষয়ের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করব তা হলো, নারীদের ইতেকাফ। আমাদের দেশে খুব কম নারীই ইতেকাফ করেন। পুরুষদের উচিত তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা এবং সুযোগ করে দেয়া। তাহলে পুরুষরাও সাওয়াব পাবেন। যদিও তাদের জন্য এটা মুস্তাহাব তবে সহজও।

বিধান একটু ভিন্ন হলেও ফজিলত তো নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমান। তারা নিজেদের ঘরেই নামাজ আদায়ের নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফ করবেন। ইতিকাফের নিয়ম মেনে তারা চাইলে সংসারের খোঁজখবর নিতে পারবেন। ফলে সংসারও ঠিক থাকবে; ইতিকাফও হয়ে যাবে। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়।

দু’বছর পর কোন বিধি-নিষেধ ছাড়াই আবারো স্বাভাবিক নিয়মে ইতিকাফের সুযোগ পাচ্ছেন দেশের মানুষ, কিভাবে কাটানো যেতে পারে এবারের ইতিকাফ?

কোরআন-হাদিসে মহামারীকে মানুষের গুনাহর ফসল বলা হয়েছে। সে হিসেবে করোনা-পরিস্থিতিও আমাদের গুনাহ ও অন্যায়ের ফসল। বান্দার গুনাহর প্রতি উদ্দামতা যখন তীব্র হয়ে উঠে তখনই আল্লাহ সতর্ক করতে বিভিন্ন পরীক্ষায় ফেলেন। যেন তারা গুনাহ থেকে নিবৃত্ত হয়।

আর ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য তো এটাই যে, এক হাদিসে নবীজি সা. বলেন, ইতেকাফকারী গুনাহকে প্রতিরোধ করে। সুতরাং বিশেষভাবে এবারের ইতেকাফকারীদের এব্যাপারে পূর্ণমাত্রায় সতর্ক থাকতে হবে।

ফেসবুক, ইউটিউব, গীবত-পরনিন্দাসহ যে সব বিষয় ইতেকাফের সঙ্গে যায় না সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। বেশি বেশি তেলাওয়াত, জিকির, নফল আমল, দীনী বিষয়ে জ্ঞান চর্চা, দোয়া ও কান্নাকাটির প্রতি মনোযোগী হতে হবে।

প্রতিটি দোয়ায় যেন পরিবার, দেশ, জাতি বিশেষ করে ওলামায়ে কেরামের প্রতি কল্যাণকামিতা থাকে। কারণ, ওলামায়ে কেরাম তো হলেন জাতির কর্ণধার।

এক কথায়, একটা সুন্দর রুটিনের মধ্য দিয়ে সময়গুলো কাটানোর মাধ্যমে মহান আল্লাহকে মানিয়ে নিতে হবে।

বলা হয়, well plan is half done সুতরাং প্রত্যেক মসজিদের ইতেকাফকারীরা পরিবেশ ও সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটা সুন্দর প্ল্যানিং ইমাম কিংবা খতিব সাহেবের দিকনির্দেশনায় নিজেরা করে নিতে পারি।

আকাবিরের ইতিকাফ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?

আমাদের নবীজি সা. লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য একবার প্রথম দশকে, একবার মাঝের দশকে, আরেকবার শেষ দশকে ইতেকাফ করেছিলেন। তারপর যখন সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, লাইলাতুল কদর রামযানের শেষ দশকেই তখন থেকে তিনি তাঁর প্রভুর সান্নিধ্যে পৌঁছা পর্যন্ত শেষ দশকেই ইতেকাফ করেছেন এবং তাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করেছেন। যার কারণে আমাদের আকাবিররা আমলটি কখনও ছাড়তেন না।

প্রসিদ্ধ আছে, যখন তাঁরা কারো বুজুর্গির ব্যাপারে আলোচনা করতেন তখন তাঁরা একথা বলতেন যে, অমুক ব্যক্তি অনেক বুজুর্গ মানুষ। কারণ, তিনি এতগুলো রমযান পেয়েছেন এবং এতগুলো ইতেকাফ করেছেন। আকাবিরদের কারো কারো খানকাহয় তো পুরা রমজান ইতেকাফের আমল ছিল এবং দূর দুরান্ত থেকে লোকেরা ইতেকাফের জন্য আসত।

দু’বছর পর ইতিকাফে কতটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরতে পারে মসজিদগুলোতে?

আমি যেখানে জুমআ’ পড়াই সেখানকার কথাই বলি। আমাদের এখানে আলহামদুলিল্লাহ দুই শতাধিক লোক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইতেকাফের জন্য আসেন। গত দু’ বছর করোনার বিধিনিষেধের কারণে এর মধ্যে ছেদ পড়ে।

এবার আলহামদুলিল্লাহ বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার কারণে পূর্বের সেই প্রাণচাঞ্চল্য আবার ফিরে আসে। এবার আলহামদুলিল্লাহ আড়াই শ’ লোকের ইন্তেজাম করা হচ্ছে। আমার সুধারণা হল, এভাবে গোটা দুনিয়ার বিশ্বাসী বান্দারা করোনার ধাক্কা থেকে আরো বেশি আল্লাহমুখী হয়ে উঠেছে। যার আশু চিত্র এবার ইনশাআল্লাহ সর্বত্র দেখা যাবে।

রমজানের শেষ দশকে যারা ইতিকাফের সুযোগ পাবেন না তারা কিভাবে সময়টা কাটাতে পারেন?

তারাও নিজেদের পরিবারের সঙ্গে মানানসই ও সহজ হয় এমন একটা লাইট প্ল্যানিং করে নিতে পারে। এর একটা ধারণা তো নবীজির হাদিস থেকেই পাওয়া যায় যে, তিনি রমযানের শেষ দশকে বেশি পরিশ্রম করতেন। কোমর বেঁধে ইবাদত করতেন। নিজে জাগতেন, পরিবারকেও ঘুমানোর সুযোগ কম দিতেন।

এত পরিশ্রম যদি কারো দ্বারা সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত সেহরির সময় যখন উঠবে তখন কিছু তাহাজ্জুদ পড়ে নেয়া যায়। এটা বিশেষভাবে এজন্য বললাম যে, শেষ দশকে যে লাইলাতুল কদর এটা তো প্রায় নিশ্চিত। আর লাইলাতুল কদরে বেহিসেবিভাবে রহমত ও শান্তি নাযিল হয়।

কিন্তু রাতটির কোন ভাগে হয় তা কেউ জানে না। তবে আল্লাহ তাআলা সূরা কদরে একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত।

এখান থেকে একটা সূক্ষ্ম বিষয় জানা গেল যে, রাতটির বরকত যখনই শুরু হবে তা শুরু হয়ে সুবহে সাদিক পর্যন্ত অবশ্যই থাকবে। সুতরাং এ সময়ে কিছু তাহাজ্জুদ পড়ে নিলে নিলে রাতটির বরকত অবশ্যই পাওয়া যাবে।