সাক্ষাৎকার ০৩

সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট-এ প্রকাশিত হয়েছে। নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হল–

ওয়াজ-মাহফিলে চুক্তিভিত্তিক আলোচনা কতটা জায়েজ?

আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশের সংস্কৃতি-ঐহিত্যের সঙ্গে মিশে আছে ওয়াজ-মাহফিল। মানুষের কাছে শান্তি-সম্প্রীতি ও ইসলামের সঠিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম প্লাটফর্ম হিসেবেও পরিচিত এ মাহফিলগুলো। শীত মৌসুমে মাহফিলগুলোকে ঘিরে ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে এক ধরনের উৎসব আমেজের দেখা মেলে। ওয়াজ-মাহফিলের বিভিন্ন ভালো মন্দ দিক নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন সময়ের আলোচিত বক্তা ও মাদরাসা শিক্ষক মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী।

ঢাকা পোস্ট : আবহমানকাল ধরে বাঙলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে ওয়াজ-মাহফিল, ইসলামের প্রচারে কতটা গুরুত্ব রাখছে মাহফিলগুলো?

মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : আমাদের দেশের শহর, গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন- বেশ পরিচিত একটি চিত্র। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও চেতনা বিস্তারের এমন এফেক্টিভ ও প্রোডাক্টিভ দৃশ্য বিশ্বের অন্য কোনো মুসলিম দেশে সাধারণত দেখা যায় না। এক বিবেচনায় এটাকে দ্বীন-ইসলামের তাবলীগ বা প্রচার-মাধ্যমও বলা যায়, আবার দীনের তালীম বা সাময়িক মাদরাসাও বলা যায়। কৃষক, দিনমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষের জন্য ধর্মীয় জ্ঞান শেখা, ইসলাম সম্পর্কে জানার সংক্ষিপ্ত পরিসরের চমৎকার একটি পাঠশালা এটি।

ওয়াজ মাহফিল, ইসলামের ওপর চলার আগ্রহ বাড়ায়, ইসলামের ওপর চলতে সাহায্য করে। কল্যাণমুখী সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে। কারণ, কীভাবে একটি সুস্থ, ইসলামি সমাজ গঠন করা যায় এ নিয়ে সেখানে ধারণা দেওয়া হয়! ওয়াজ মাহফিল ব্যক্তিজীবনে পরিবর্তন নিয়ে আসে। সাহাবা, অলি-আউলিয়াদের কথা ঘটনা শুনে মানুষের মাঝে এক ধরনের পরিবর্তন আসে। নিজের জীবনেকে পূর্ববর্তীদের মতো করে গড়ার অনুপ্রেরণা তৈরি হয়।

সুতরাং ইসলামের অনাবিল সৌন্দর্য বিস্তারে ওয়াজ-মাহফিলের গুরুত্ব ও অবদান অনস্বীকার্য।

ঢাকা পোস্ট :  মাহফিলগুলো থেকে সাধারণ মানুষ ইসলামের সঠিক বার্তা পাচ্ছেন কতটা?

মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : প্রশ্নটি কেন করছেন, আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তাহলে আমি বলবো, এর কারণ হল, ওয়াজ-মাহফিলের এমন কিছু বেখাপ্পা-চিত্র, যা সত্যিই ওয়াজ-মাহফিলের মত গুরুগম্ভীর বিষয়ের সঙ্গে যায় না কিংবা ওয়ায়েজ বা ধর্মীয় বক্তার মত শ্রদ্ধাবান ব্যক্তিসত্ত্বার সঙ্গে মানায় না। এখন তো কত বক্তার কত নাম! কমেডিয়ান বক্তা, সার্কাস বক্তা, আরো কত কী! এজাতীয় শুধু সুন্দর সুর-কণ্ঠ, মাঠ কাঁপানো ও কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের দিয়ে আজীবন ওয়াজ করালেও ইসলামের সঠিক বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছবে না–এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতনতার পরিচয় দিতে পারলে, ইলম ও আমলে সমৃদ্ধ আলেম ও বুজুর্গ ব্যক্তিদের মাহফিলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিলে তারা সাদামাটা সহজ সরল লৌকিকতাহীনভাবে যে ওয়াজ করে থাকেন সেগুলোর অভূতপূর্ব প্রভাবও তো অস্বীকার করা যায় না।

ঢাকা পোস্ট : একজন বক্তা -যার কাছ থেকে মানুষ ধর্মীয় বিষয়ে জানবেন, নিজেকে পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন, তার মাঝে কী কী গুণ থাকা অবশ্যক? এক কথায় বক্তার মাঝে কী কী ধর্মীয় গুণ থাকা আবশ্যক?

মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : আমার আগের কথাগুলোর মধ্যে এর প্রতি কিছুটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এক কথায়, বক্তার ইলম ও আমল দেখে তাকে দাওয়াত দিতে হবে। শুধু আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য ওয়াজ করতে চান এবং কোরআন-হাদীসের পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন, দরদ ও সহমর্মিতার সঙ্গে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন, ঈমানী দায়বদ্ধতার অনুভুতি আছে- এমন দায়িত্বশীল ও বিচক্ষণ আলেমদেরকেই কেবল মাহফিলে আলোচনার জন্য আহ্বান করা উচিত।

পাশাপাশি দূরদর্শী হওয়া, সব বিষয়ে মতামত না দেওয়া বা কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য না করা, নিজের বিদ্যা ও পাণ্ডিত্য জাহির না করা, হিকমতের সঙ্গে কথা বলা, প্রয়োজন মতো কোরআনের আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করা, শব্দ–বাক্য ও উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়া, তাজবিদসহ বিশুদ্ধ তিলাওয়াত করা, গ্রামারসহ আরবি পাঠ করা, কথায় ও কাজে মিল থাকা, উম্মতের (জাতির) ইসলাহ তথা সংশোধন ও কল্যাণকামিতার মনোভাব থাকা, ইতিবাচক কথা ও আশার বাণী শোনানো–এগুলোও একজন বক্তার অপরিহার্য গুণ হওয়া উচিত। ফাতাওয়া আলমগীরিতেও একথাগুলো বলা হয়েছে।

ঢাকা পোস্ট :  একজন বক্তার মধ্যে যেসব গুণ থাকা আবশ্যক, তা না থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি শুধু বাকপটুতার জোরে মাহফিলের মঞ্চগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তাহলে এতে দ্বীন-ইসলামের কতটা ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেন?

মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : দেখুন, ডাক্তারের হাতে অস্ত্র আর সন্ত্রাসীর হাতে অস্ত্র কী সমান হয়! অনুরূপভাবে বলা বাহুল্য, যে বক্তার মধ্যে এ সব জরুরি গুণগুলো থাকবে না; উপরন্তু যদি সে গলাবাজির মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠে তাহলে তার মাধ্যমে দ্বীন ও ইসলাম আবাদ হবে না; বরং দীনের কবরস্থান রচিত হবে। মানুষের কাছে ইসলামের ভুল ম্যাসেজ পৌঁছবে। ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মাঝে নেতিবাচক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠবে।

আরেকটু বিস্তারিত বললে বলা যায়, এ জাতীয় বক্তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠলে মৌলিকভাবে কয়েকটি ক্ষতি হয়।

১. মানুষের মাঝে ইসলামের ভুল শিক্ষার বিস্তার লাভ করে।

২. আলেম-ওলামা সম্পর্কে মানুষের মাঝে খারাপ ধারণা তৈরি হয়।

৩. মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য তীব্র হয়ে হয়ে ওঠে।

৪. ইসলামের শত্রুরা এ নিয়ে ট্রল করার সুযোগ পায়।

৫. যারা ইসলাম সম্পর্কে জানতে চায়, তাদের আগ্রহের মাঝে বাঁধা সৃষ্টি হয়।  ইত্যাদি।

যার তিক্ত বাস্তবতা বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং এ নিয়ে শীর্ষ আলেম-ওলামা ও সচেতন-মহল বেশ শঙ্কিত।

ঢাকা পোস্ট :  বর্তমানে মানুষ যখন ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ভুল ধারণা পাচ্ছে বলে মনে করা হয়-ঠিক এই সময়ে বক্তারা আলোচনার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে পারেন?

মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : সর্ব অঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথায়! সময়টা ফেতনামুখর; এটাই তিক্ত বাস্তবতা। যাই হোক, হাদিসে বলা হয়েছে, এ সময়ে সকালের মুমিন লোকটি সন্ধ্যায় এবং সন্ধ্যার মুমিন লোকটি সকালে ঈমানহারা হয়ে যাবে। এই হাদিস থেকে এই ফেতনামুখর সময়ে আলমেদের কী নিয়ে বেশী কথা বলা দরকার, তার একটা দিকনির্দেশনাও আমরা পেয়ে যাই। তাহল-

আলোচনার ক্ষেত্রে ঈমান এবং তার বিপরীতে কুফর, শিরক ও নিফাকসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রাধান্য পাওয়া দরকার। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিপরীতে ইসলামের স্বকীয়তা, সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা সম্পর্কে মানুষকে বোঝানো প্রয়োজন। পাশাপাশি দেশ থেকে দুর্নীতি এবং পরিবার ও সমাজ থেকে অশান্তি ও অসঙ্গতি দূর করতে করতে হলে প্রয়োজন চরিত্রের বিশুদ্ধতা বা আত্মশুদ্ধি। এগুলোও আলোচকদের আলোচনায় গুরুত্ব পাওয়া চাই।

ঢাকা পোস্ট :  বক্তা নির্বাচনে মাহফিলের আয়োজকদের কোন কোন বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত?

মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : আগেই বলেছি যে, সুর ও কমেডির পেছনে না পড়ে মাহফিলের আয়োজকদের উচিত, বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতনতা, সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া। সাধারণত জনগণ থেকে টাকা-পয়সা তুলে মাহফিলগুলোর আয়োজন করা হয়। সুতরাং এক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া মানে পাবলিকের সঙ্গে খেয়ানত করা। এজন্য আয়োজকদের উচিত বক্তার ইলম ও আমল দেখে তাকে দাওয়াত দেওয়া। এক্ষেত্রে ইউটিউবে সার্চ না করে বক্তা না খুঁজে বরং নিজ এলাকার সচতেন ও মুত্তাকি আলেম-ওলামার সঙ্গে পরামর্শ করে নিলে বিষয়টা সহজ হয়ে যাবে।

ঢাকা পোস্ট : জ্ঞানের গভীরতা না থাকা সত্ত্বেও শুধু বাকপটুতার জোরে জনপ্রিয়তা পাওয়া বক্তাদের জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে মাহফিলের আয়োজক কমিটির কোনও দায় আছে বলে মনে করেন কি?

মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : অবশ্যই আছে। এর জন্য আল্লাহর কাছে তাদেরকে জবাবদিহী করতে হবে। মানুষের টাকা মানুষের কল্যাণে ব্যয় না হলে এটা তো বান্দার হক। আর বান্দার হকের বিষয়টি খুবই কঠিন বিষয়। সুতরাং আবারও বলছি, সচেতনতা, সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া আয়োজক কমিটির কেবল সাধারণ কর্তব্য নয়; বরং ঈমানী দায়িত্ব।

ঢাকা পোস্ট :  অনেক বক্তা মাহফিলের মঞ্চে গান-সংগীতের বিভিন্ন অংশ বলেন, তাদের ভাষা অনুযায়ী এটা ‘শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়া’র চেষ্টা থেকে করা হয়- বক্তাদের এমন কাজকর্ম মাহফিলগুলোর গাম্ভীর্যতা কতটা ক্ষূণ করছে বলে মনে করেন বা বক্তা হিসেবে আপনারাই এতে বিব্রতবোধ করছেন কিনা?

মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়া’র চেষ্টা–এ যুক্তি দিয়ে গান-সংগীতের বিভিন্ন অংশ বলা; এটা যে কত বড় বালখিল্যতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যিনি গানের কলি আওড়ালেন তিনি এটা কীভাবে মুখস্থ করলেন; এই প্রশ্ন কি সরলমনে এসে যায় না? এ নিয়ে ‘লা হাও লা… বলা ছাড়া আর কী ই বা বলবো! আল্লাহর কাছে দোয়া করি, জাতিকে এদের বিষক্রিয়া থেকে হেফাজত করুন।

ঢাকা পোস্ট : মাহফিলে আলোচনার জন্য চুক্তি করে টাকা নেওয়া বা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার জন্য আয়োজকদের জোরাজোরি করা- ইসলামের দৃষ্টিতে বিষয়টি কতটা সমর্থনযোগ্য?

মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : চুক্তি করে টাকা নেওয়া বা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার জন্য আয়োজকদের জোরাজোরি করা মোটেও উচিত নয়। এমন আলোচকের আলোচনার মাধ্যমে মানুষ হেদায়েত না পাওয়ার আশংকাই প্রবল। কেননা, পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা তাঁর অনুকরণ করো যে, তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চায় না। আর এমন লোকেরাই হিদায়েতপ্রাপ্ত’। (কোরআন, ৩৬:২০)

সুতরাং আলোচকদের উচিত, শুধু আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে দ্বীন-ইসলামের দাওয়াতের মানসকিতা নিয়ে ওয়াজ করা। আর আয়োজকদের উচিত, এ নিয়ে সংকীর্ণ মনের পরিচয় না দিয়ে সাধ্য অনুযায়ী হাদিয়া দেয়ার চেষ্টা করা। হাদিসে এসেছে, হাদিয়া দিলে মহব্বত বাড়ে।

ঢাকা পোস্ট :  বক্তা ও শ্রোতাদের উদ্দেশে কিছু বলতে চাইবেন কি?

মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এছাড়া আলহাদুলিল্লাহ, পেছনের কথাগুলোর মধ্যে অনেক কথাই চলে এসেছে। তবে একটা বিষয়ের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ শোনা তারপর ফজরের নামাজ কাজা করা এটা অনেকটা লুঙ্গি খুলে পাগড়ি বাঁধার মত। এজন্য গভীর রাত পর্যন্ত মাহফিল নয়। হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. এটা শক্ত ভাষায় নিষেধ করেছেন। একইভাবে মাইকের অতিরিক্ত ব্যবহারও বর্জন করা উচিত।

ঢাকা পোস্ট :  ধন্যবাদ ঢাকা পোস্টকে সময় দেওয়ার জন্য।

 মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী : আপনাকেও ধন্যবাদ। আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিন।