সালাফ ও আকাবিরের গল্পকথা-০১ : অন্তর

সবচেয়ে বড় বিপদ
হুযায়ফা ইবনু ক্বাতাদা রহ. বলেন

أَعْظَمُ المَصَائِبِ قَسَاوَةُ القَلْبِ

সবচেয়ে বড় বিপদ হল অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়া। (সিয়ার, জীবনী নং ১৩৯২)

দু’টি স্বভাব অন্তরকে কঠোর করে দেয়
ফুযাইল ইবনু ই’য়ায রহ. বলেন

خَصْلَتَانِ تُقَسِّيَانِ الْقَلْبَ : كَثْرَةُ الْكَلَامِ ، وَكَثْرَةُ الْأَكْلِ

দু’টি স্বভাব অন্তরকে কঠোর করে দেয়। অতিরিক্ত কথা এবং অতিরিক্ত আহার। (বাইহাকী; আযযুহদুল কাবীর : ১৭৬)

অন্তর ছয় কারণে নষ্ট হয়
হাসান বসরী রহ. বলেন

فساد القلوب متولد من ستة أشياء: يذنبون برجاء التوبة، ويتعلمون العلم ولا يعملون به، وإذا عملوا لا يخلصون، ويأكلون رزق الله ولا يشكرون، ولا يرضون بقسمة الله، ويدفنون موتاهم ولا يعتبرون

অন্তর ছয় কারণে নষ্ট হয়ে যায়
১. তাওবা করে নিবে এই আশায় গুনাহ করে।
২. ইলম শিখে তবে আমল করে না।
৩. আমল করে তবে ইখলাস থাকে না।
৪. আল্লাহর রিজিক আহরণ করে কিন্তু শোকর আদায় করে না।
৫. আল্লাহর বণ্টনে খুশি থাকে না।
৬. মৃতদেরকে দাফন করে কিন্তু এ থেকে উপদেশ গ্রহন করে না।

দশ কারণে অন্তর মরে যায়
ইবরাহীম ইবনু আদহাম রহ. বসরা শহরের একটি বাজারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। লোকজন তাঁর পাশে সমবেত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আবু ইসহাক! আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো। কিন্তু আমরা অনেক প্রার্থনা করার পরেও আমাদের দোয়া কবুল হচ্ছে না।
তখন তিনি বললেন, ‘ওহে বসরার অধিবাসী, দশটি ব্যাপারে তোমাদের অন্তর মরে গেছেÑ

عرفتم الله ولم تؤدوا حقه
زعمتم أنكم تحبون رسول الله ﷺ وتركتم سنته
قرأتم القرآن فلم تعملوا به
أكلتم نعم الله ولم تؤدوا شكرها
قلتم إن الشيطان عدو لكم ولم تخالفوه
قلتم إن الجنة حق ولم تعملوا لها
قلتم إن النار حق ولم تهربوا منها
قلتم إن الموت حق ولم تستعدوا له
انتبهتم من النوم فاشتغلتم بعيوب الناس ونسيتم عيوبكم
دفنتم موتاكم ولم تعتبروا بهم

১. তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে অবগত কিন্তু তাঁর প্রদত্ত কর্তব্যসমূহ পালন কর না।
২. তোমরা দাবী কর রাসূলুল্লাহ ﷺ—কে ভালোবাসো কিন্তু তাঁর সুন্নাহকে পরিত্যাগ কর।
৩. তোমরা কুরআন পড় কিন্তু সে অনুযায়ী আমল কর না।
৪. তোমরা নিজেদেরকে শয়তানের শত্রু হিসেবে দাবী কর কিন্তু তোমরা তার পদাংক অনুসরণ কর।
৫. তোমরা জান্নাতে যেতে উদগ্রীব কিন্তু তার জন্য পরিশ্রম কর না।
৬. তোমরা জাহান্নামের ভয়ে আতঙ্কিত কিন্তু পাপের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তার নিকটবর্তী হচ্ছো।
৭. তোমরা স্বীকার কর মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর না।
৮. ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর থেকে তোমরা সর্বদা অন্যের দোষ বের করতে সচেষ্ট। কিন্তু নিজের দোষ—ত্রুটির ব্যাপারে উদাসীন।
৯. তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ উপভোগ কর কিন্তু তার জন্য শুকরিয়া আদায় কর না।
১০. তোমরা মৃতদেহের দাফন সম্পন্ন করার পর তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর না। (হিলয়াতুল আউলিয়া : ৮/১৫, ১৬)
আমাদেরও কি ভেবে দেখা উচিৎ নয় আমাদের অন্তর এসব ব্যাপারে মরে গেছে কিনা?

অন্তরের চোখ
মুজাহিদ রহ. বলেন

لكل إنسان أربع أعين: عينان في رأسه لدنياه، وعينان في قلبه لآخرته، فإن عميت عينا رأسه وأبصرت عينا قلبه فلم يضره عماه شيئا، وإن أبصرت عينا رأسه وعميت عينا قلبه فلم ينفعه نظره شيئا

প্রত্যেক মানুষের চারটি করে চোখ আছে। দুনিয়া দেখার জন্য তার মাথায় স্থাপিত দু’টি চোখ এবং তার আখেরাত অবলোকনের জন্য হৃদয়ের দু’টি চোখ। তার অন্তরের চোখ যদি ভালো থাকে, তাহলে তার মাথার চোখ অন্ধ হলেও সেই অন্ধত্ব তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু অন্তরের চোখ যদি অন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মাথার চোখ দৃষ্টিসম্পন্ন হলেও এই দৃষ্টিশক্তি তার কোনোই উপকার করতে পারে না। (তাফসীরে কুরতুবী : ১২/৭৭)

অন্তর তিন জায়গায় তালাশ কর
আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযি. বলেন

اطلب قلبك في ثلاثة مواطن: عند سماع القرآن، وفي مجالس الذكر، وفي وقت الخلوة، فإن لم تجده في هذه المواطن، فاعلم أنه لا قلب لك فسل الله قلبًا آخر

তোমার অন্তর তিন জায়গায় তালাশ কর। এক. কোরআন শোনার সময়। দুই. জিকিরের মজলিসগুলোতে। তিন. একাকীত্বের সময়ে।
যদি উক্ত তিন জায়গায় তুমি অন্তরটা খুঁজে না পাও তাহলে জেনে রেখো, মূলত তোমার অন্তরটা নেই। সুতরাং আল্লাহ তাআলার কাছে এর পরিবর্তে আরেকটি অন্তর ভিক্ষা কর। (আলফাওয়াইদ, ইবনুল কাইয়্যিম : ১/১৪৯)

অন্তরের পরিশুদ্ধতার গুরুত্ব না দেয়ার পরিণতি
ইবনুল জাওযী রহ. বলেন

كَمْ مِنْ مُتَعَبِّدٍ يُبَالِغُ فِيْ كَثْرَةِ الصَّلاةِ وَالصَّوْمِ وَلا يُعَانِيْ صَلاحَ الْقَلْبِ، وَقَدْ يَكُوْنُ عِنْدَهُ الْكِبْرُ وَالرِّيَاءُ وَالنِّفَاقُ وَالْجَهْلُ بِالْعِلْمِ وَلا يُحِسُّ بِذَلِكَ

বহু ইবাদতগুযার লোক আছে, যারা বেশি বেশি নামায আদায় করে, রোজা রাখে, কিন্তু অন্তরের পরিশুদ্ধতার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় না। ফলে নিজের অজান্তেই তাদের মনে অহংকার, লৌকিকতা, মুনাফিকী ও অজ্ঞতার অনুপ্রবেশ ঘটে যায়। ( ইবনুল জাওযী, আত—তাবসিরাহ : ২/২০৮)

ওয়াজ-নসিহত ভালো লাগে না কখন?
মালেক ইবন দীনার রহ. বলেন

إِنَّ الْبَدَنَ إِذَا سَقِمَ لَمْ يَنْجَعْ فِيهِ طَعَامٌ وَلَا شَرَابٌ وَلَا نَوْمٌ وَلَا رَاحَةٌ، وَكَذَلِكَ الْقَلْبُ إِذَا عَلِقَهُ حُبُّ الدُّنْيَا لَمْ تَنْجَعْ فِيهِ الْمَوَاعِظُ

শরীর অসুস্থ হয়ে পড়লে যেমন পানাহার ঘুম ও আরাম ভালো লাগে না, অনুরূপভাবে অন্তর দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লে ওয়াজ-নসিহত ভালো লাগে না। ( ইবনু আবিদ্দুনয়া, আযযুহদ : ১৪২)

অন্তরের আরোগ্য
ইয়াহইয়া ইবনে মু‘আয রহ. বলেন

دواء القلب خمسة أشياء، قراءة القرآن بالتفكر، وخلاء البطن وقيام الليل، والتضرع عند السحر، ومجالسة الصالحين

পাঁচটি জিনিসে অন্তরের আরোগ্য রয়েছে—
১. চিন্তা-গবেষণা করে কুরআন তেলাওয়াত।
২. পেট খালি রেখে খাদ্য গ্রহণ।
৩. কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ।
৪. শেষ রাতের কাকুতি-মিনতি করে দোয়া এবং
৫. নেককার মানুষের সাহচর্য। ( ইবনুল জাওযী, সিফাতুস সাফওয়া : ২/২৯৩)

অন্তরের কঠিনতা থেকে বাঁচতে হলে
একজন লোক হাসান বসরী রহ.-কে জিজ্ঞেস করলেন

يا أبا سعيد، أشكو إليك قسوة قلبي

হে আবু সাঈদ! আপনার নিকট অন্তর কঠিন হওয়ার অভিযোগ করছি।

তিনি বললেন

أذبه بالذكر

তুমি (অন্তরের কঠিনতা থেকে বাঁচতে) জিকির করবে। ( ইবনুল জাওযী, যাম্মুল হাওয়া : ৬৯)