যে মেয়ের অভিযোগ মা-বাবা তাকে পছন্দ করে না; তার প্রতি নসিহত

জিজ্ঞাসা–১৫৩৪: মা বাবা আমাকে পছন্দ করেন না। এটা ছোট থেকেই। আমি ভুল ভাবছি এটা নিজেকে বুঝিয়েছি। কিন্তু পরিবারের অনেক সদস্য আমাকে অপছন্দের কারণ জিজ্ঞেস করায় আমি ব্যাপারটা নিশ্চিত হলাম। একাধিক বার এর কারণ জানতে চেয়েছিলাম। বলেছেন আমার দোষ। একই কাজ অন্য কেউ করলে মাফ পেয়ে যায়। আমি কোনো ব্যাপারে মাফ পাব না কেন? এটা নিয়ে অনেক ঝামেলা করেছি। তাছাড়া আমি যা করি, তার দশগুণ বেয়াদবি অন্যরা করে। ওদের কিছুই বলা হয় না । তাই বর্তমানে আমি চাইলেও তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে পারি না। এতে কি পরিমাণ গুনাহ হচ্ছে?–বিথী।

জবাব: প্রিয় দীনী বোন, ইসলাম জানিয়েছে, মা-বাবা যেমনই হোক, তাঁদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা, মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করা, ভালবাসা, তাঁদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা, কথা শোনা, গুরুত্ব দেওয়া, বাধ্য হওয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াজিব। মায়ের পদতলে জান্নাত। বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং বাবার অসন্তষ্টিতে আল্লাহর অসন্তষ্টি। মা-বাবার অবাধ্য হওয়া, তাদেরকে রাগান্বিত করা— হারাম এবং কবিরা গুনাহ; এমনকি সেটা যদি শুধু উফ্‌ উফ্‌ শব্দ উচ্চারণ করার মাধ্যমে হয় তবুও। কোরআন-হাদিসের অসংখ্য স্থানে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহর বাণী:

وَقَضَى رَبُّكَ أَلا تَعْبُدُوا إِلا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلا كَرِيمًا وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا

তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে `উফ্‌’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলআর মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল ‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। (সূরা বনী ইসরাইল: ২৩-২৪)

এ ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক দলিল; এ পরিসরে সবগুলো উল্লেখ করা সম্ভব নয়। শুধু এটা মনে রাখবেন, পিতামাতার সেবা ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাঁদের মুসলমানও হওয়া জরুরী নয়। মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا

পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। (সূরা লুকমান :১৫)

সুতরাং আলোচ্য ক্ষেত্রে আপনি যা করবেন তাহল–

এক- আপনার মুসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। সুতরাং তাঁদের সঙ্গে অসদাচারণ না করে ধৈর্য ধারণ করবেন। বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, যেন তোমার তাঁদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ : إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ

মুমিনের অবস্থা ভারি অদ্ভুত। তাঁর সমস্ত কাজই তাঁর জন্য কল্যাণকর। মুমিন ব্যাতিত অন্য কারো জন্য এ কল্যাণ লাভের ব্যাবস্থা নেই। তাঁরা আনন্দ (সুখ শান্তি) লাভ করলে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে, তা তাঁর জন্য কল্যাণকর হয়, আর দুঃখকষ্টে আক্রান্ত হলে ধৈর্যধারণ করে, এও তাঁর জন্য কল্যাণকর হয়। (মুসলিম ৭২২৯)

দুই- তাঁরা  যদি অন্যায় আদেশ করেন (যেমন, গুনাহর আদেশ করেন কিংবা ফরজ-ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ইবাদতে বাঁধা দেন) এবং এর জন্য অন্যায়ভাবে রাগ করেন তাহলে হেকমতের সঙ্গে তাঁদের অন্যায় আদেশ এড়িয়ে চলবেন এবং তাঁদেরকে সাথে সাথে নয়; বরং পরবর্তীতে মমতার সঙ্গে ইসলামের এই মূলনীতি বুঝিয়ে বলবেন যে, ইসলামের শিক্ষা হল, لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা যেখানে আসবে, সেখানে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। কেননা, সৃষ্টির আনুগত্যের সীমারেখা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল বলেন, فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ অর্থাৎ অসৎকাজে আনুগত্য নয় ;আনুগত্য কেবলমাত্র সৎকাজের ক্ষেত্রেই হতে হবে’’। (সহীহ বুখারী ৭১৪৫)

তিন- আপনার প্রতি তাঁদের রাগ করা ও অসৌজন্য আচরণের অন্যতম কারণ হল, দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও দীনের প্রতি মহব্বতের ঘাটতি। এজন্য আপনি মমতাপূর্ণ নসিহতের মাধ্যমে অব্যাহত চেষ্টা ও দোয়া চালিয়ে যাবেন, দেখবেন, একদিন আপনি সফল হবেন এবং তাঁদের এই অপূর্ণতা দূরীভূত হবে। কেননা, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَا كَانَ الرِّفْقُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ وَلَا نُزِعَ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا شَانَهُ

যে বিষয়ে নম্রতা ও কোমলতা থাকে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়। যে বিষয়ে কোমলতা থাকে না, তা দোষণীয় হয়ে পড়ে। (মুসলিম ৪৬৯৮)

পরিশেষে, আমার এ লেখাটি আপনার মা-বাবাকে পড়ে শোনানোর অনুরোধ রইল। এতে তাঁরা সন্তানের মনোবেদনা কিছুটা হলেও অনধাবন করবেন বলে আশা করা যায়।

والله أعلم بالصواب

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − sixteen =