রমজানকে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতে ভাগ করা কতটুকু সহিহ?

জিজ্ঞাসা–১৩৬৬: রমজানের রোজাকে যে রহমত, নাযাত এবং মাগফিরাত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, এটা কি কোরআন বা সহি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত? প্রমাণসহ জানালে উপকৃত হতাম। ধন্যবাদ।– মোহাম্মদ মনির হোসেন।

জবাব: এ বিষয়ে প্রথমে আরব বিশ্বের সর্বোচ্চ ফতোয়া কমিটি ‘ফাতাওয়া লাজনাতিদ্দায়িমা’-এর বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হল,

সালমান রাযি. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটি ইবনে খুযাইমা তাঁর ‘সহীহ’ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রমজান মাসের ফযিলত শীর্ষক পরিচ্ছেদ; যদি এ হাদিসটি সহীহ সাব্যস্ত হয়। এরপর তিনি বলেন, আমাদের নিকট আলী ইবনে হুজর আল-সাদী হাদিস বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, আমাদের নিকট ইউসুফ ইবনে যিয়াদ হাদিস বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, আমাদের নিকট হুমাম ইবনে ইয়াহইয়া হাদিস বর্ণনা করেছেন আলী বিন যায়িদ বিন জুদআন হতে; তিনি সাঈদ ইবনে আল-মুসাইয়্যিব হতে, তিনি সালমান রাযি. হতে; তিনি বলেন,

خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ فِي آخِرِ يَوْمٍ مِنْ شَعْبَانَ فَقَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ أَظَلَّكُمْ شَهْرٌ عَظِيمٌ مُبَارَكٌ شَهْرٌ فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مَنْ أَلْفِ شهر جعل الله تَعَالَى صِيَامَهُ فَرِيضَةً وَقِيَامَ لَيْلِهِ تَطَوُّعًا مَنْ تَقَرَّبَ فِيهِ بخصلة من الْخَيْرِ كَانَ كَمَنْ أَدَّى فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ وَمَنْ أَدَّى فَرِيضَةً فِيهِ كَانَ كَمَنْ أَدَّى سَبْعِينَ فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ وَهُوَ شَهْرُ الصَّبْرِ وَالصَّبْر ثَوَابه الْجنَّة وَشهر الْمُوَاسَاة وَشهر يزْدَاد فِيهِ رِزْقُ الْمُؤْمِنِ مَنْ فَطَّرَ فِيهِ صَائِمًا كَانَ لَهُ مَغْفِرَةً لِذُنُوبِهِ وَعِتْقَ رَقَبَتِهِ مِنَ النَّارِ وَكَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أَجْرِهِ شَيْءٌ» قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ لَيْسَ كلنا يجد مَا نُفَطِّرُ بِهِ الصَّائِمَ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ : «يُعْطِي اللَّهُ هَذَا الثَّوَابَ مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا عَلَى مَذْقَةِ لَبَنٍ أَوْ تَمْرَةٍ أَوْ شَرْبَةٍ مِنْ مَاءٍ وَمَنْ أَشْبَعَ صَائِمًا سَقَاهُ اللَّهُ مِنْ حَوْضِي شَرْبَةً لَا يَظْمَأُ حَتَّى يَدْخُلَ الْجَنَّةَ وَهُوَ شَهْرٌ أَوَّلُهُ رَحْمَةٌ وَأَوْسَطُهُ مَغْفِرَةٌ وَآخِرُهُ عِتْقٌ مِنَ النَّارِ وَمَنْ خَفَّفَ عَنْ مَمْلُوكِهِ فِيهِ غَفَرَ الله لَهُ وَأعْتقهُ من النَّار

একবার শাবান মাসের শেষ দিন রাসূলুল্লাহ আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবা (ভাষণ) দিলেন। খুতবা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, হে লোকেরা! তোমাদের নিকট এক মহান মাস হাজির হয়েছে। এক বরকতময় মাস এসেছে। এ মাসে এমন এক রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ মাসে সিয়াম পালন করা আল্লাহ ফরজ করেছেন এবং এ মাসের রাতে কিয়াম (নামায আদায়) করা নফল করেছেন। এ মাসে যে কোন একটি (নফল) ভালো কাজ করা অন্য মাসে একটি ফরজ কাজ করার সমান। আর এ মাসে কোন একটি ফরজ আমল করা অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আমল করার সমান। এটি হল ধৈর্য্যের মাস; ধৈর্য্যের প্রতিদান হচ্ছে- জান্নাত। এটি হল- সহানুভূতির মাস। এটি এমন এক মাস যাতে একজন মুমিনের রিযিক বৃদ্ধি পায়। এ মাসে যে ব্যক্তি কোন একজন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার সমূহ গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে, সে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবে এবং তাকে সেই রোজাদারের সমান সওয়াব দেয়া হবে; কিন্তু রোজাদারের সওয়াবে কোন কমতি করা হবে না। তারা বললো, আমাদের মধ্যে সবার তো একজন রোজাদারকে ইফতার করানোর মত সামর্থ্য নেই। তখন রাসূলুল্লাহ বললেন, কোন ব্যক্তি যদি একজন রোজাদারকে একটি খেজুর অথবা এক ঢোক পানি অথবা এক চুমুক দুধ দিয়েও ইফতার করায় আল্লাহ তাকেও এই সওয়াব দিবেন। এটি এমন মাস এর প্রথম ভাগে রহমত, দ্বিতীয় ভাগে মাগফিরাত এবং শেষ ভাগে রয়েছে জাহান্নাম হতে নাজাত। আর যে ব্যক্তি তার কৃতদাসের দায়িত্ব সহজ করে দিবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং জাহান্নাম থেকে তাকে মুক্তি দিবেন। সুতরাং এ মাসে তোমরা চারটি কাজ বেশি করে করবে। দুটি হল যা দিয়ে তোমরা নিজেদের রব্বকে সন্তুষ্ট করবে। আর দুটি কাজ এমন যা তোমাদের না করলেই নয়। যে দুটি কাজ দ্বারা তোমরা নিজেদের রব্বকে সন্তুষ্ট করবে, (১) এ বলে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই এবং (২) তাঁর কাছে ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আর যে দুটো কাজ তোমাদের না করলেই নয় (৩) তোমরা আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করবে এবং (৪) জাহান্নামের আগুন থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। আর এই মাসে যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে পেট ভরে খাওয়াবে আল্লাহ তাঁকে আমার হাউজ থেকে এক ঢোক পানি পান করাবেন যার ফলে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসার্ত হবে না।

উল্লেখিত হাদিসের সনদে একজন রাবী হচ্ছেন আলী বিন যায়েদ বিন জুদআন। তিনি একজন যয়ীফ বা দুর্বল রাবী। যেহেতু তার মুখস্থশক্তি দুর্বল ছিল। হাদিসটির সনদে আরও একজন রাবী হচ্ছেন ইউসুফ বিন যিয়াদ আল-বসরী। তিনি মুনকারুল হাদিস। হাদিসটির সনদে আরও একজন রাবী হচ্ছেন হুমাম বিন ইয়াহইয়া বিন দীনার আল-আউদী। তার সম্পর্কে ইবনে হাজার ‘আত-তাক্বরীব’ গ্রন্থে বলেছেন, তিনি ছিকাহ তথা শক্তিশালী তবে কখনো কখনো ভুল করেন।

এই পর্যালোচনার উপর ভিত্তি করে বলা যায়, এ সনদে হাদীসটি মিথ্যা বা জাল নয়; তবে  যয়ীফ বা দুর্বল। এটি দুর্বল হলেও রমজানের ফযিলত বিষয়ক সহীহ হাদিস তো যথেষ্ট রয়েছে।

আল্লাহই তাওফিক দাতা। আমাদের নবীর প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।  সমাপ্ত।

গবেষণা  ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি

শাইখ আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লাহ ইবনে বায্‌। শাইখ আব্দুর রায্‌যাক আফীফি, শাইখ আব্দুল্লাহ বিন গুদাইইয়্যান, শাইখ আব্দুল্লাহ বিন কুঊদ।

[ফাতাওয়াল্‌ লাজনাহ আদ্‌দায়িমা (ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র) (১০/৮৪-৮৬)]

প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, আরব বিশ্বের সর্বোচ্চ ফতোয়া কমিটির উক্ত দীর্ঘ বক্তব্য ও পর্যালোচনায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, উক্ত হাদীসের সূত্র বা সনদ যয়ীফ বটে; তবে হাদীসটি মিথ্যা বা জাল নয়। আর মুহাদ্দিসগণের স্বীকৃত মূলনীতি হল, যয়ীফ হাদীস আমল ও বর্ণনাযোগ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের এক শ্রেণীর লোক জাল আর যয়ীফ হাদীস এর পার্থক্য বুঝে না। প্রকৃত পক্ষে জাল কোন ভাবেই হাদীস না তা রাসূল ﷺ  এর উপর মিথ্যারোপ শুধু। কিন্তু যয়ীফ হাদীস যা রাসূলﷺ  থেকে সাব্যস্ত কিন্তু সূত্রে মাঝে কোন বর্ণনাকারীর কারণে তা যয়ীফ হয়েছে।

والله اعلم بالصواب

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twenty + six =