দাইয়ুসের পরিচয় এবং বাবা-মা যদি পুত্রবধূকে পর্দা পালনে বাঁধা দেয়…

জিজ্ঞাসা–১০৯২: আসসালামু আলাইকুম। হুজুর, স্ত্রীকে যদি তার স্বামী ভাসুর বা দেবরের সাথে কথা বলতে নিষেধ করে, সেক্ষেত্রে স্বামীর মা বাবা চায় কথা বলবে, খানা দিবে এবং বলে, ঘরের মানুষের সামনে পর্দা করা জরুরি নয়। এ সমস্ত মা বাবাকে কি বলে ইসলাম? ওরা কি জান্নাতের অধীবাসী হবে নাকি দাইয়ুসের অন্তর্ভুক্ত। দয়া করে উত্তর দিবেন।–জাকির আখন্দ।

জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

এক. দাইয়ুসের পরিচয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

اَلدَّيُّوْثُ هُوَ الَّذِيْ لَا يُبَالِيْ مَنْ دَخَلَ عَلٰى أَهْلِهِ

দাইয়ুস হলো সে ব্যক্তি যে, তার পরিবারের নিকট কে প্রবেশ করল এ ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করে না। (তাবরানি ১৩১৮০ আততারগিব ওয়াততারহিব ৩৪৭৬)

অপর হাদিসে রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

الدَّيُّوثُ الَّذِي يُقِرُّ فِي أَهْلِهِ الْخَبَثَ

ওই ব্যক্তিকে দাইয়ুস বলা হয় যে, তার পরিবারের অশ্লীলতাকে মেনে নেয়। (মুসনাদে আহমাদ ৫৩৭২)

একারণে ইবনু হাজার হাইথামি রহ. বলেন,

قال العلماء : الديوث الذي لا غيرة له على أهل بيته

‘আলেমগণ বলেছেন, দাইয়ুস বলা হয়, যে নিজের পরিবারের অশ্লীলতার ব্যাপারে দায়িত্ববোধহীন বা আত্মমর্যাদাহীন।’ (আযযাওয়াজির ২/৩৪৭)

আর দাইয়ুস যে জান্নাতে যাবে না; এ মর্মে একাধিক হাদিস রয়েছে। যেমন, এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ اللهَ سُبْحَانَهُ وَتَعَالٰى لَمَّا خَلَقَ الْجَنَّةَ قَالَ : وَعِزَّتِيْ وَجَلاَلِيْ لَا يَدْخُلُكِ بَخِيْلٌ وَلَا كَذَّابٌ وَلَا دَيُّوْثٌ

নিশ্চয়ই সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু তাআ’লা যখন জান্নাত সৃষ্টি করেছেন তখন জান্নাতকে বলেছেন, আমার সম্মান-গৌরব ও পরাক্রমশালীর শপথ, কৃপণ (সম্পদে আল্লাহ তা‘আলার অধিকার বিনষ্টকারী), মিথ্যাবাদী (কোরআন-সুন্নাহকে মিথ্যাপ্রতিপন্নকারী) এবং দাইয়ুস ব্যক্তি তোমার মধ্যে প্রবেশ করবে না। (নাসাঈ, যাকাত অনুচ্ছেদ ২৫৬২ মুসনাদে আহমাদ ২/১৩৪)

দুই. উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা বলা যায়, যে বা যারা কোনো নারীকে তার দেবর ও ভাসুরের সঙ্গে অবাধ চলাফেরা করতে বাধ্য করে সে হাদিসের ভাষ্য মতে দাইয়ুস। কেননা, দেবর বা ভাসুর মাহরামের অন্তর্ভুক্ত নয় বিধায় তাদের সঙ্গে পর্দা ফরজ। রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ الْحَمْوُ الْمَوْتُ

তোমরা (মাহরাম নয় এমন) নারীদের নিকট গমণ করা পরিত্যাগ কর। জনৈক আনসারী ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! দেবর সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি বললেন, দেবর তো মৃত্যু সমতুল্য। (বুখারী ৫২৩২ মুসলিম ৫৫৬৭)

তিন. প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, আল্লাহ আমার ধারণা ভুল করুন, যদি প্রশ্নোক্ত পরিস্থিতির শিকার আপনি নিজে এবং আপনার স্ত্রী হন, তাহলে প্রশ্নের ধারালো ভাষা থেকে অনুমিত হচ্ছে যে, বিষয়টি কেন্দ্র করে আপনিও আপনার মা-বাবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে থাকেন। অথচ মা-বাবাকে অবহেলা করা হারাম ও কবিরা গুনাহ। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই তাঁদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। কেননা, মা-বাবা সর্বাবস্থায় সদ্ব্যবহারে হকদার; এমন কি তারা অমুসলিম হলেও।  আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا

পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। (সূরা লুকমান ১৫)

সুতরাং আপনি যা করতে পারেন তা হল, যেমন–

১. আপনার বাবা-মাকে, আপনার ভাইদেরকে হেকমত, বুদ্ধিমত্তা ও বিনয়ের সাথে পর্দার গুরুত্বের প্রতি দাওয়াত অব্যাহতভাবে দিতে থাকবেন। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ

মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। (সূরা তাহরীম ৬)

২. বিশেষ করে আপনার বাবাকে ও পরিবারের অন্যান্য পুরুষ সদস্যকে কোন হক্কানী আলেমের সঙ্গে সম্পর্ক করিয়ে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনি প্রথমে তাকে কোন হক্কানী আলেমের বয়ান শোনার জন্য আগ্রহী করে তুলতে পারেন। ওলামাদের মজলিসে আসা যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে পারেন। অথবা তাকে দাওয়াত-তাবলিগে কিছু সময় দেয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِينَ

হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা আত তাওবাহ ১১৯)

৩. তাঁদের হেদায়তের জন্য দোয়া নিয়মিত দোয়া করবেন। আশাহত হয়ে চেষ্টা কিংবা দোয়া বর্জন করা যাবে না। ইনশাআল্লাহ একদিন না একদিন সাফল্য পাবেন। وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ যে আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট। (সূরা ত্বলাক ৩) রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,لاَ يَرُدُّ الْقَضَاءَ إِلاَّ الدُّعَاءُ ভাগ্য পরিবর্তন হয় না দোয়া ব্যতীত। (তিরমিযী ২১৩৯)

৪. যেহেতু স্বামীর অন্যতম কতর্ব্য হলো স্ত্রীর জন্য এমন একটি বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যেখানে স্ত্রী পর্দা পালন করতে যেয়ে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর প্রতিবন্ধকতার শিকার হবেনা, সেহেতু স্বামীর কতর্ব্য হল, যৌথপরিবার যদি এক্ষেত্রে বাঁধা হয় তাহলে স্ত্রীকে নিয়ে পৃথক হয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে যদি বাবা-মা মনোকষ্ট নেয় তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা, ইসলামের শিক্ষা হল,لا  طاعة لمخلوق في معصية الخالق অর্থাৎ, আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা যেখানে আসবে, সেখানে সৃষ্টির আনুগত্য কোনো অবস্থাতেই করা যাবেনা।

আমরাও দোয়া করি, আল্লাহ উক্ত পরিবারকে পরিপূর্ণ হেদায়াত দান করুন। আমিন।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
শায়েখ উমায়ের কোব্বাদী
আরো পড়ুন–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × one =